বিশেষ লেখা
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উত্তাল পরিস্থিতি ও প্রাণনাশের ঘটনায় প্রথম আলোকে একটি প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠিয়েছেন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী। নিম্নবর্গের ইতিহাস ও উত্তর-উপনিবেশতত্ত্বের তিনি প্রথিতযশা অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর।
একেকটা সময় আসে যখন আমাদের দেশের জন্য মন খুব ভারী হয়। আমরা নিজেদের মনেই কাঁদি। কখনো ‘পরের’ দেশের জন্যও কাঁদি। বিশেষত, যদি সেই দেশের জন্য মনের মধ্যে ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশ আমার দেশ নয়। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। কিন্তু আজ বাংলাদেশের সঙ্গে একটি নাড়ির সম্পর্ক বোধ করি। এই বোধ এক দিনে হয়নি। ছোটবেলা থেকেই জানি, আমার মা-বাবার দেশ বিক্রমপুর। মায়ের জন্ম নারায়ণগঞ্জে, বিএ পাস করা ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। বাবার গ্রাম ফুরশাইল। কিন্তু আমি তো কলকাতায় মানুষ। ১৯৪৮ সালের শেষে জন্ম। যে কলকাতায় বড় হয়েছিলাম, সেখানে হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ মুজতবা আলী বা কাজী আবদুল ওদুদের মতো মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং তাঁদের লেখার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় থাকলেও আমাদের জীবনের আবহটা ছিল ‘হিন্দু’। সেই সময়কার বাংলা চলচ্চিত্রে যেমন কোনো বাঙালি মুসলমান ঘরের ছবি দেখে বড় হইনি, তেমনি আমাদের প্রিয় রোমান্টিক ‘আধুনিক’ গানের সব প্রতীক ও থিমই ছিল সংস্কৃতিগতভাবে ‘হিন্দু’।
আজ আমি আমার সব বাংলাদেশি বন্ধু, প্রায় ৫০ বছরের ওপর তাঁদের কাছে পাওয়া অকৃপণ ভালোবাসা, শিক্ষা; তাঁদের ইতিহাস-সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে নিজেকে ভাবতে পারি না। মনের মধ্যে কলকাতা আর ঢাকা যেন একই শরীরে দুটি চোখের মতো জেগে থাকে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আমাদের জীবনে আসতে শুরু করল। আমি ভারত ছাড়লাম ১৯৭৬ সালের শেষে। অস্ট্রেলিয়ায় গেলাম ডক্টরেট ডিগ্রির সন্ধানে। সেখানেই বাংলাদেশকে চেনার শুরু। চেনা অর্থ বাংলাদেশের মানুষকে চেনা। তাঁদের বন্ধু হওয়া, তাঁদের জীবনের সুখ-দুঃখকে জানা। কখন দেখলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার রবীন্দ্রসংগীত, ফকির আলমগীরের গান আমার জীবনের সম্পদ হয়ে গেল! আজ আমি আমার সব বাংলাদেশি বন্ধু, প্রায় ৫০ বছরের ওপর তাঁদের কাছে পাওয়া অকৃপণ ভালোবাসা, শিক্ষা; তাঁদের ইতিহাস-সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে নিজেকে ভাবতে পারি না। মনের মধ্যে কলকাতা আর ঢাকা যেন একই শরীরে দুটি চোখের মতো জেগে থাকে।
তাই আজ অস্থির জ্বলন্ত বাংলাদেশকে দূর থেকে দেখে আমার মুখে কথা নেই। আমি বিদেশি মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক নই। বাংলাদেশের অস্থিরতার কারণ কী, তার সমাধানের সুরাহাই-বা কী হতে পারে—এগুলো বাংলাদেশের মানুষ, তাঁদের রাজনৈতিক-সামাজিক নেতারা স্থির করবেন। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত যা-ই হোক, সেগুলো ব্যক্তিগতই। কিন্তু এত তরুণ তাজা প্রাণের আহুতি ও আত্মাহুতি, আর এত রাষ্ট্রীয়, অর্থাৎ জনগণের সম্পত্তি আক্ষরিক অর্থে জ্বলতে দেখে আমিও বিচলিত না হয়ে পারি না। যে পক্ষের মানুষেরই প্রাণ যাক, প্রতিটি প্রাণহানির কাহিনি আসলে তাঁদের পরিবারের অশ্রু-জলের কাহিনি।
স্তম্ভিত হয়েই ভাবি, বস্তুত না ভেবে পারি না যে আজ ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এক বিশাল আগ্নেয়গিরির মতো এত ক্ষোভের উদ্গিরণ কোথা থেকে, কীভাবে হলো? একটি গোটা দেশ ও জাতির এই যে মানসিক আঘাত বা ইংরেজিতে বললে ট্রমা—এর অভিঘাত কী হবে, আর এর ভবিষ্যৎটাই-বা কী?
আমার মা বলতেন, ‘যার যায়, তার যায়।’ মৃত মানুষকে নিয়ে ‘তুমি কোন দলে?’ প্রশ্ন করার মধ্যে যে অমানবিকতা থাকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রসঙ্গে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। আবার বাড়িঘর, জাতীয় সম্পত্তি যা ধ্বংস হলো, তার খেসারতও দেবেন বাংলাদেশের মানুষই। এ-ও তাঁদেরই ক্ষতি। ‘প্রটেকশন অব লাইফ অ্যান্ড প্রপার্টি’—এভাবেই তো আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করেছিলেন ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস। কিন্তু যা স্তম্ভিত করে দেয়, তা সমাজের অভ্যন্তরের এই জমা হয়ে থাকা বিস্ফোরক ক্ষোভ। আজ দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ—তা তাঁরা দেশেই থাকুন কি বিদেশে—যে একটা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন, তা নিয়ে তো সন্দেহ নেই।
স্তম্ভিত হয়েই ভাবি, বস্তুত না ভেবে পারি না যে আজ ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এক বিশাল আগ্নেয়গিরির মতো এত ক্ষোভের উদ্গিরণ কোথা থেকে, কীভাবে হলো? একটি গোটা দেশ ও জাতির এই যে মানসিক আঘাত বা ইংরেজিতে বললে ট্রমা—এর অভিঘাত কী হবে, আর এর ভবিষ্যৎটাই-বা কী?
বাংলাদেশের এক সামান্য অনাগরিক শুভার্থী হিসেবে আমি আর কী চাইতে পারি?
আমি কার্যকারণের প্রশ্ন তুলছি না। কার কী বা কতটা দোষ, কার কী ও কতটা দায়িত্ব, সেসব বিশ্লেষণ করার এখতিয়ার, যোগ্যতা, অধিকার আমার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনেক বেশি। এসব প্রশ্ন উঠবে, তর্ক হবে, অধিকারী যাঁরা এ নিয়ে কথা বলবেন। তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনব। ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পরিসরে সেই আলোচনায় সম্ভব হলে যোগ দিই ও দেব। কিন্তু একটা কথা ভাবি এবং এখানে তুলতে চাই। এই যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অশান্তি ও সার্বিক মানসিক আঘাত দেখে আমার মন তোলপাড় হয়ে যায়, সে তো বর্তমানে পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশগুলোর অসম্ভব অন্যায় ও নিষ্ঠুরতা দেখে যে অসহায়ভাবে বিক্ষুব্ধ হই, তার চেয়ে ধরনে একটু আলাদা! আমার মতো বিদেশি বাঙালির মন এমন কাঁদে কেন? কেন বারবার চাই, এক স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে উঠুক, যাকে দেখে শুধু বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষ নয়, পৃথিবীর সব বাঙালি মাথা উঁচু করে হাঁটবে?
তার কারণ আজ পৃথিবীর সব না হলেও অনেক বাঙালির কাছে—বাংলাদেশি নন, এমন বাঙালির কথা বলছি—বাংলাদেশ শুধু এক বেদনাবিদ্ধ অঞ্চলমাত্র নয়, বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুতির নামও বটে। কিসের প্রতিশ্রুতি? ‘বাঙালি’—এই পরিচিতি, এই সত্তাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতির জন্ম হয়তো ভাষা আন্দোলনের গর্ভে, কিন্তু এর জীবন শুরু ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের জন্মের মুহূর্তে। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ছিল সেই প্রতিশ্রুতি—এক মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলামের গুরুত্ব স্বীকার করেও এক অসাম্প্রদায়িক, উন্নয়নশীল, গণতান্ত্রিক, ন্যায়নিষ্ঠ, প্রধানত বাংলাভাষী ও বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী এক ভূখণ্ড গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি।
আমাদের পুরোনো ও যৌথ বাঙালি সত্তার প্রতি এই দায়িত্ব পালন করার ভূমিকায় আমার জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ সহজে অনুমেয় কিছু সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণেই আজ বাংলাদেশের চেয়ে কমজোরি। এ কথা বাংলাদেশের বাইরেও অনেকে স্বীকার করবেন। পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাকে ভালোবাসি, ভারতকে ভালোবাসি তার বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যের জন্য। সেই আশ্চর্য বৈচিত্র্যের শরিক হয়েও এবং জীবনের নানান পরিস্থিতিতে নিজেকে ‘বিশ্বনাগরিক’ মনে হলেও প্রাথমিক পরিচয়ে আমি বাঙালি, আর আমারও আদর্শ অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মনুষ্য-সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ও লালনের মন্ত্রে আমি দীক্ষিত। সন্দেহ নেই যে দেশভাগ সত্য, ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ নিতান্ত বাস্তব, তবু বাংলাদেশই সেই দেশ, যেখানে এই পরিচয় আর আদর্শ; একই সঙ্গে অকুণ্ঠচিত্তে আজও উচ্চারিত হয়।
বাঙালির সত্তা ও পরিচিতির ঐতিহাসিক দায়িত্ব আজ বাংলাদেশের হেফাজতে। এই দেশ যখন কাঁদে, তখন আমরা সবাই কাঁদি, এর রিক্ততায় নিজেকে রিক্ত বোধ করি। তাই মনেপ্রাণে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেরও মঙ্গল প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি, আজকের হৃদয়মন্থন থেকে হিংসার গরলের বদলে কোনো শান্তির অমৃত উঠে আসুক। বাংলাদেশের যিনি ভাগ্যবিধাতা, তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও জনগণকে আজকের বিক্ষুব্ধ ও অস্থির সময় থেকে নিষ্ক্রমণের কোনো বাস্তব ও স্থায়ী পথ দেখান। কোনো এক মিলনের প্রাঙ্গণে আমাদের সবাইকে নিয়ে যান, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পতাকার নিচে বিশ্বের বাঙালি আবার জমায়েত হতে পারে।
বাংলাদেশের এক সামান্য অনাগরিক শুভার্থী হিসেবে আমি আর কী চাইতে পারি?