‘বাবার লাশ ফেরত দেন, একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই’
গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিতে সরকারের কাছে আবারও দাবি জানালেন বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা স্বজনেরা।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই কেঁদে ফেলে ছোট্ট আদিবা। শুধু এটুকু বলতে পেরেছে, ‘পাপাকে (বাবা) ছাড়া একটুও ভাল্লাগে না আমার। কিচ্ছু ভাল্লাগে না।’
আদিবার বয়স যখন দুই বছর, তখন থেকেই সে আর তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এখন তার বয়স ১১ বছর। সে বিশ্বাস করে, একদিন না একদিন সে তার বাবাকে খুঁজে পাবে। শনিবার বিকেলে মায়ের হাত ধরে আদিবা হাজির হয় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে তাদের মতো ৪২টি পরিবার ছিল, যারা প্রিয় মানুষের খোঁজ পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় রয়েছে।
আমার বাবাকে যদি মেরে ফেলে থাকেন, তাহলে লাশটা একটু দেখতে দিন। আমি আমার বাবার লাশটা দেখতে চাই। আমি বাবাকে শেষবারের মতো একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।হাফসা ইসলাম, ২০১৩ সালে গুমের শিকার সাজেদুল ইসলামের মেয়ে
আদিবা ইসলামের বাবা পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর শাহবাগ থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় পারভেজকে। গত আট বছরেও তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই। তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, এ নিয়ে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কিছু বলতে পারছে না।
আদিবার বাবার মতো হাফসা ইসলামের বাবা সাজেদুল ইসলামও নিখোঁজ হন ২০১৩ সালে। বাবার কথা বলতে গিয়ে হাফসা বলেন, ‘আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, আমার বাবাকে যদি মেরে ফেলে থাকেন, তাহলে লাশটা একটু দেখতে দিন। আমি আমার বাবার লাশটা দেখতে চাই। আমি বাবাকে শেষবারের মতো একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।’
বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা গতকাল মানববন্ধন করেছেন প্রেসক্লাবের সামনে। তাঁরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, গুম হওয়া প্রিয় স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে। যদি জীবিত ফেরত দিতে না পারে, তাহলে অন্তত লাশ যাতে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর উদ্যোগে এই মানববন্ধন করা হয়।
এর আগে গত বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি। উল্লেখ্য, মিশেল ব্যাশেলেত গত সপ্তাহে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
তারা ‘আয়নাঘরে’
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো বে। এই কারাগারে বন্দীদের নির্যাতনের কারণে সারা পৃথিবী তাদের ধিক্কার দিচ্ছে। অথচ তারাও প্রকাশ করে কারা কারাগারে আছে, আর কারা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে শত শত মা, মেয়ে, বাবা কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনদের। সরকার সেটা প্রকাশ করছে না। কী অপরাধ করেছিল তারা? শুধু কথা বলেছিল তারা, এই তাদের অপরাধ।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান চেয়ে বহু অনুষ্ঠান হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি বলে মন্তব্য করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, তারা এক কান দিয়ে শুনবে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে। নিখোঁজ স্বজনেরা কোথায়—এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করতে হবে এই সরকারকে।
সরকারের কাছে যখন গুমের অভিযোগ করা হয়, সব সময় সরকার সেটা অস্বীকার করে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘তারা (সরকার) বলে, ৬০০ থেকে ৭০০ লোক নাকি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই সরকার ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়, তারা কেন ৭০০ লোককে খুঁজে বের করতে পারে না।’
গুমের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের দাবি থাকবে, গুমের ঘটনার তদন্ত করবেন। লোক দেখানো ফালতু তদন্ত না। মানবাধিকারকর্মীদের কমিটিতে রাখতে হবে। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের রাখতে হবে। বাংলাদেশে সর্বজন শ্রদ্ধেয় যেসব বিচারক অবসরে গেছেন, তাঁদের রাখতে হবে।’
যে রাষ্ট্র নির্যাতন করে, সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, রাষ্ট্র এখন সন্ত্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নাগরিকদের গুম করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, কারও মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি নিয়ে পরের প্রজন্ম বাঁচে। কিন্তু গুম করার মধ্য দিয়ে মানুষকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমন নিকৃষ্টতার কোনো তুলনা হয় না। সরকার নানা নামে গুমকে ‘জায়েজ’ করছে।
গুমের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ করেন গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক। তিনি বলেন, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পরে কারও অবস্থান শনাক্ত হয়েছে জেলখানায়। অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ। তাঁদের ‘আয়নাঘরে’ রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের আয়নাঘর নামের গোপন কোনো জায়গায় আটকে রাখা হয়।
তবু ভাইয়ের লাশটা দেন
গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ও জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব।
মানববন্ধনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিখোঁজ বিএনপির নেতা চৌধুরী আলমের ভাই খুরশিদ আলম বলেন, ‘আমার ভাইকে যদি মেরে ফেলা হয়, লাশটা অন্তত ফেরত দিন। আমি একমুঠো মাটি দেওয়ার অধিকার চাই। আজকে না হয় কাল দেন, কাল না হয় পরশু দেন। তবু ভাইয়ের লাশটা দেন।’
সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন প্রায় ১২ বছর আগে।
মানববন্ধনে মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম বলেন, গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কমিটি করা হোক। আয়নাঘরে যাঁরা আছেন, তাঁদের জীবিত অবস্থায় পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন তিনি।