টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের আধার এই হাওর ঘিরেই বিকশিত হয়েছে নতুন ধারার ‘হাওর-পর্যটন’। এখানে প্রচলিত নৌকার বাইরেও দুই শতাধিক হাউসবোট চলে। বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর হাওরে পর্যটন মৌসুম। এবার কয়েক দফা বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে জমে ওঠেনি হাওর পর্যটন।
সুনামগঞ্জ হাউসবোট মালিক সমিতির সভাপতি মো. আরাফাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটন মৌসুমে আমরা যে ট্রিপ পরিচালনা করি, এবার তার এক-তৃতীয়াংশ ট্রিপও হচ্ছে না। এখন নির্ধারিত প্যাকেজ মূল্যে ছাড় দিতে হচ্ছে। আগে যেখানে একটি ট্রিপ পরিচালনা করলে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ থাকত, এখন সেটি ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।’
দেশের পর্যটনশিল্পের এমন বাস্তবতা নিয়েই আজ ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। পর্যটন দিবসে জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থা ইউএনট্যুরিজমের প্রতিপাদ্য ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড পিস’।
এদিকে তিন মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সেদিন থেকেই সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করেছেন পর্যটকেরা।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আজম বলেন, ‘গত মৌসুমে ২ লাখ ২৫ হাজার পর্যটক সুন্দরবনে এসেছিলেন। এর মধ্যে রিজার্ভ ফরেস্ট বা তিন দিনের ট্যুরে এসেছিলেন প্রায় ২৬ হাজার পর্যটক। বাকিরা সুন্দরবনের প্রান্তসীমায় যে নয়টি পর্যটনস্থান আছে, সেখানে দিনে এসে দিনে ভ্রমণ করে গেছেন। বুকিং পূর্বাভাস থেকে ধারণা করা যায়, এবার এই পর্যটকের সংখ্যা কমবে।’
প্রতিবছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের পর্যটন খাত সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করে। তবে এবার এই মৌসুম নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিক ঘটনায় যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে, আমরা তা প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।
বান্দরবানে ‘শনির দশা’, কক্সবাজারে নিরাপত্তাঝুঁকি
বান্দরবানের নাফাখুম, দেবতাখুমের মতো বুনো জলপ্রপাত ও দুর্গম পথে ট্রেকিংয়ের রোমাঞ্চসহ পাহাড়ি মানুষের জীবনযাপনের সাক্ষাৎ পেতে তরুণদের অনেকেই বান্দরবানের গহিনে যান; কিন্তু চার বছর ধরে এই জেলার পর্যটন একের পর এক সমস্যায় ধুঁকছে। যার শুরুটা হয়েছিল করোনা মহামারির কড়াকড়ির সময়। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের আবির্ভাবে বিভিন্ন উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটনস্থান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, গত বছরের ভয়াবহ বন্যা আর সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি—সব মিলিয়ে বান্দরবানে পর্যটনে এখনো ‘শনির দশা’ চলছে।
বান্দরবানের হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বান্দরবানের মানুষের রুটিরুজির অন্যতম খাত পর্যটন। চার বছরে অনেকে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, মালিকেরা ঋণের দায়ে হোটেল-রিসোর্ট বিক্রি করে দিচ্ছেন। এখনো পর্যটক টানতে ৫০-৬০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে হোটেল-মোটেলগুলো। তারপরও পর্যটক আসছেন না। বন্ধ পর্যটন স্পটগুলো দ্রুত খুলে দিতে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ জারি রেখেছি।’
বান্দরবানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় ছিল পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। তবে রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতার পর অবরোধে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটন। রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রের রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেববর্মণ বলেন, ‘সারা বছরই সাজেকে পর্যটক আসেন। আশা করি, কিছুদিনের মধ্যে চলমান পরিস্থিতির উন্নতি হবে, আবার পর্যটকও আসবেন।’
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণ–গন্তব্য কক্সবাজারেও এখন পর্যটক–খরা চলছে। বিভিন্ন হোটেল-রিসোর্ট বড় ছাড় দিয়েও পর্যটক পাচ্ছে না। সম্প্রতি কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বৈরী পরিবেশে সাগর উত্তাল থাকা, ভারী বর্ষণে শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ৫২ দিন কক্সবাজারে পর্যটক আসেননি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, পুলিশ-প্রশাসন সক্রিয় হলে এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থা ফিরে পেলেই পর্যটক আসতে শুরু করবেন।
রেড অ্যালার্ট প্রত্যাহারের চেষ্টা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের পর নানা সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে বেশ কিছু দেশ। ফলে বাতিল হয়েছে বিদেশি পর্যটকদের অগ্রিম বুকিং।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে আমরা নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক ঘটনায় যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে, আমরা তা প্রত্যাহারের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করছি, সামগ্রিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’
পর্যটনের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, ‘একটি দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে। তবে আমরা আসন্ন মৌসুমটাকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগও কম থাকে। স্বাভাবিকভাবে এই মৌসুমে মানুষ বেশি ঘুরে বেড়ান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চলে আসবে বলেই মনে হচ্ছে। আমরাও বিদেশি পর্যটক আনার ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’