প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভার) শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ, ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। তারা বলেছে, এ ধরনের মামলা ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে।
সাভার থেকে তুলে আনা প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয় মঙ্গলবার মধ্যরাতে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর রমনা থানায় একই আইনে, একই অভিযোগ তুলে আরেকটি মামলা হয়। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে। শামসুজ্জামানও এই মামলার আসামি।
২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ারের সময় ‘গ্রাফিক কার্ডে’ ছবির অমিলকে কেন্দ্র করে দেশের ভাবমূর্তি ও অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিযোগ এনে মামলা দুটি করা হয়। যদিও ফেসবুকের ওই পোস্টে অসংগতি দ্রুতই নজরে পড়ে এবং তা সরিয়ে নিয়ে সংশোধনী প্রকাশ করা হয়।
এই পোস্টকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা প্রথম আলোর সমালোচনা করে আসছেন। একই সঙ্গে দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করছে। এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দুটি হয়। মামলা দুটির মধ্যে প্রথমটির বাদী ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ গোলাম মো. কিবরিয়া। অপরটির বাদী আইনজীবী আবদুল মালেক (মশিউর মালেক), যিনি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভার) শামসুজ্জামানকে তেজগাঁও থানার মামলা নয়, রমনা থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তার সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে মুক্তির দাবি জানিয়েছেন সম্পাদক পরিষদ, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (নোয়াব) বিভিন্ন মানবাধিকার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা ধরনের হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়। এখনো তাঁর বিরুদ্ধে অর্ধশত মামলা রয়েছে।
মধ্যরাতে মামলা
গত বুধবার ভোর চারটায় সাভার থেকে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার ২০ ঘণ্টা পরও যখন তাঁর খোঁজ জানা যাচ্ছিল না, এমন একটা অবস্থায় খবর আসে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে।
কিন্তু মামলাটি নিয়ে অনেকটা লুকোচুরি করে রমনা থানা-পুলিশ। ওই রাতে মামলার বিষয়ে রমনা থানার পুলিশ প্রথমে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে বুধবার মধ্যরাতে প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক রমনা থানায় গেলে তাঁদের থানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। এ সময় থানার সামনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিক অবস্থান করেছিলেন। তাঁদেরও থানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে রাত ১টা ৫৫ মিনিটে মামলার বাদী আবদুল মালেকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি নিজেকে হাইকোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘মামলাটার আমি এজাহার দায়ের করেছি, হয়েছে (মামলা) কি না, জানি না। হয়েছে কি না, ওরা (পুলিশ) যোগাযোগ করেছে কোথায় কোথায়, পুলিশের ব্যাপার তো, বোঝেন না।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সংবাদকর্মীরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁরা অবিলম্বে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রতিবেদক শামসুজ্জামান এবং যুগান্তর–এর বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাসহ এই আইনে সংবাদকর্মীদের নামে যত মামলা হয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানান। একই সঙ্গে শামসুজ্জামানের মুক্তি দাবি করা হয়।
সম্পাদক পরিষদ বলেছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের সংবাদপত্রশিল্প ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত।
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে তাঁকে হয়রানি ও তাঁর পত্রিকার সাহসী সাংবাদিকতাকে ভয় দেখানো হচ্ছে বলে মনে করে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)।
নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদের সই করা বিবৃতিতে প্রথম আলো সম্পাদক ও নোয়াবের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের মুক্তি দাবি করা হয়। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায় সংগঠনটি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ আমাদের কাছে শঙ্কাজনক মনে হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে আমাদের আপত্তি জানিয়েছি। এ ধরনের আইন মুক্ত মতপ্রকাশ, স্বাধীন সাংবাদিকতা তথা প্রাগ্রসর সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ও পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। দুই সংগঠনের নেতারা অবিলম্বে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে বিনা পরোয়ানায় ভোররাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা হয়রানিমূলক। এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে। এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে এবং ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে।
প্রথম আলোর সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে নেওয়া এবং ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এক বিবৃতিতে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২২-এর তথ্য উল্লেখ করে টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২-তে, যা কিনা আফগানিস্তানের (১৫৬) চেয়েও নিচে। এই অবস্থান নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও শাসক দলের মাধ্যমে তার যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের প্রতিফলন।
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান ও সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তাঁরা মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনগুলো বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা রকম নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব আইনের জেরে সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি তাঁদের পেশাগত নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বাসায় রাতে বেআইনি তল্লাশি ও আটকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। ব্লাস্ট বলছে, এ ঘটনায় বেআইনি আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়েছে।