এসব বাক্সে ছিল লাখ লাখ টাকা, পুড়ে সব ছাই
কেউ ১৫ বছর, কেউ ২০ বছর আগে গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছিলেন জীবন বদলাতে। দোকানে চাকরি করে কয়েক বছরের বেতনের টাকা জমিয়ে একসময় নিজেরাই দোকান দিয়েছিলেন। ব্যবসাও দাঁড়িয়েছিল তাঁদের। ১৫–২০ লাখ টাকার মূলধন হয়েছিল কারও কারও। কিন্তু আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব তাঁরা। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া পাঁচ হাজার দোকানের অনেক মালিকেরই এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে যখন ব্যবসা আবার চাঙা হয়ে উঠছিল, সে সময় ঈদ সামনে রেখে আরও বেশি টাকার মালামাল কিনেছিলেন দোকানিরা। ঈদুল ফিতরের এই কেনাবেচায় আরও মুনাফার আশা করেছিলেন। কিন্তু আগুনে সেই সব মালামালই শুধু পোড়েনি, দোকানগুলোতে টাকা রাখার বাক্সগুলোতে জমানো লাখ লাখ টাকাও পুড়েছে। পুড়েছে আয়–ব্যয়ের হিসাব, ব্যাংকের চেকসহ প্রয়োজনীয় নানা ধরনের কাগজ।
ঢাকায় জামাকাপড়ের অন্যতম বড় বাজার বঙ্গবাজারের এই দোকানিরা এখন দিশাহারা। সরকারের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা কোনোভাবে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
এই দোকানিদের একজন মো. সম্রাটের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। ২০ বছর আগে ঢাকায় আসেন তিনি। বঙ্গবাজারের একটি দোকানে মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। টানা ১০ বছর চাকরি করেন সম্রাট। এরপর কৃষক বাবার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। আর নিজের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ২০১৪ সালে একটা দোকান ভাড়া নেন। নাম দেন চিশতী জালাল গার্মেন্টস।
কয়েক বছর অনেক কষ্ট করে ব্যবসা দাঁড় করান সম্রাট। ৯ বছরের মাথায় তাঁর পুঁজি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। ঈদ সামনে রেখে নতুন করে চার লাখ টাকার গেঞ্জি তুলেছিলেন বলে জানান সম্রাট। তিনি বলেন, দোকানে লোহার সিন্দুকে দুই লাখ টাকা রেখেছিলেন। দুই দিন আগে ঢাকা থেকে যান গ্রামের বাড়ি। মঙ্গলবার ভোর ছয়টায় পরিচিত একজন দোকানদার সম্রাটকে আগুন লাগার খবর মুঠোফোনে জানান। তখন সঙ্গে সঙ্গে ফরিদপুর থেকে বাসে উঠে পড়েন। দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছান যাত্রাবাড়ী। সেখান থেকে চলে আসেন বঙ্গবাজারে। দেখতে পান, বঙ্গবাজারের দোকান একে একে পুড়ে যাচ্ছে।
চিশতী জালাল গার্মেন্টসের মালিক সম্রাট প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখের সামনে দোকানগুলো পুড়ে গেল। আমার দোকানের মালামাল পুড়ে গেল। আরও পুড়ল আমার সিন্দুকে থাকা দুই লাখ টাকাও।’
মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। সকাল ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ৪১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পরে ৫০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে। দুপুরের দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবাজারে আগুনে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিকেল চারটায় বঙ্গবাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া কিছু দোকানে তখনো আগুন জ্বলছিল। তবে পুরোপুরি নিভে যাওয়া দোকানের সামনে তখন উৎসুক লোকের ভিড়।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেল পোড়া শাড়ি, লুঙ্গি, গেঞ্জিসহ দোকানের লোহার শাটার, পুড়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক পাখা আর টাকা রাখার লোহার বাক্স।
এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আরেকজন জুয়েল রানা লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ১৫ বছর আগে। তিনি বঙ্গবাজারে কাজ নিয়েছিলেন মামার দোকানে। আট বছর মামার দোকানে কাজ করার পর স্বপ্ন দেখেন, নিজেই দোকান দেবেন। তখন প্রবাসী বাবার কাছ থেকে নেন দেড় লাখ টাকা। নিজের সঞ্চিত অর্থ আর বাবার টাকায় বঙ্গবাজারে দোকান ভাড়া নেন। দোকানের নাম দেন এম আর গার্মেন্টস। সাত বছর ব্যবসা ধীরে ধীরে বড় করেছেন। কিছু ঋণ থাকলেও তাঁর পুঁজি ২০ লাখ টাকার ওপরে। ঈদের আগে দোকানে অন্তত ছয় লাখ টাকার গেঞ্জি তুলেছেন।
সোমবার রাত ১০টায় দোকান বন্ধ করে বাসায় যান জুয়েল রানা। সকাল সাতটায় আগুন লাগার খবর পেয়ে মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় বঙ্গবাজারে আসেন। জুয়েল রানা বলেন, ‘সামনে ঈদ। রোজার ঈদের আগেই মূলত আমাদের ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন এলাকার দোকানিরা আমাদের বঙ্গবাজার থেকে মাল কিনে নিয়ে যান। আমার দোকানেও বেচাকেনা শুরু হয়েছে। মালামাল বিক্রির ছয় লাখ টাকা সিন্দুকে রেখেছিলাম। কিন্তু এই আগুনে আমার সব পুড়ে ছাই। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুন যে কেবল ফরিদপুরের সম্রাট কিংবা লক্ষ্মীপুরের জুয়েল রানাকে পথে বসিয়েছে, তা নয়। এই দুজনের মতো শত শত দোকানির জীবিকার সম্বল পুড়ে শেষ হয়েছে।
পুড়েছে ব্যাংকের চেক, অন্যান্য কাগজপত্র
বঙ্গবাজারের অন্তত ১৫ জন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগুনে ব্যাংকের চেক, মালামাল কেনা, বিক্রির রসিদসহ ব্যবসাসংশ্লিষ্ট নানা কাগজপত্র পুড়ে গেছে।
আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মোর্শেদ আলম নামের এক ব্যবসায়ী পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে যান। তবে আগুনে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোনটি তাঁর নিজের দোকান, সেটা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি কয়েকটি দোকানের পুড়ে যাওয়া ক্যাশ বাক্স খুলে দেখান, টাকা আর কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত আরও বেশ কয়েকজন দোকানমালিককে এসে পুড়ে যাওয়া ক্যাশ বাক্সগুলো খুলে দেখতে দেখা যায়। লোহার বাক্সগুলো থেকে পোড়া টাকার বান্ডিল বের করে হাহাকার করছিলেন তাঁরা। এ সময় আকরাম নামের এক তরুণ কয়েকটি সিন্দুক খুলে পোড়া জিনিসপত্র হাতে নিয়ে বলেন, ব্যবসার আয়-ব্যয়ের হিসাব, ব্যাংকের চেক, মালামাল বিক্রির তথ্য, টাকা সবই থাকে সিন্দুকে। এই আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। সরকার যেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সহায়তার হাত বাড়ায়, সে জন্য অনুরোধ জানান মোর্শেদ আলম। আরেক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে এই দোকান দিয়েছি। এই আগুন আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমার ২৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। সরকার যদি একটু সহযোগিতা করে, তাহলে হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’