‘মরেই তো গিয়েছিলাম, এটা আমার এক্সটেনশন লাইফ’
করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে গিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) চিকিৎসক অনীক চন্দ। আক্রান্ত হয়ে যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে নতুন জীবনও পেয়েছিলেন তিনি। অনীকের ভাষায় যেটি তাঁর ‘এক্সটেনশন লাইফ’। যেখানে করোনা রোগীর সেবায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন, সেই চমেক হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে অনীক একাধিক সহকর্মীর মৃত্যুও দেখেছেন। বার কয়েক ফিরেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে। এখনো কি ভুলতে পেরেছেন সেই দুঃসহ দিনের কথা? ভুলতে যে দিচ্ছে না করোনা–পরবর্তী শারীরিক জটিলতা।
করোনার চার বছর কেটে যাচ্ছে। সুস্থ হয়ে ফিরেছেন রোগীর সেবায়। তবে এখনো প্রায় প্রতি মাসেই চমেক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার অনীক চন্দের জ্বর লেগে থাকে। করোনার ছোবল শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভেঙে দিয়েছে। একটুতে হাঁপিয়ে ওঠেন। করোনা–পরবর্তী জটিলতায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে দাঁতেও। এত শত অসুখ, তবু হেসেখেলে আনন্দে জীবনটা কাটাতে চায় অনীক-মনিকা দম্পতি। সুযোগ পেলেই এখানে–সেখানে বেরিয়ে পড়েন দুজন। অনীক প্রায়ই বলেন, ‘কী আছে জীবনে। মরেই তো গিয়েছিলাম। মনিকা না হলে আমি বাঁচতাম না।’
মনিকা চন্দও পেশায় চিকিৎসক। অনীককে সারিয়ে তুলতে গিয়ে হাসপাতালে নিজেও কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবু যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বামীকে ফেরাতে তিনি যেন ত্রিশূল ধরেছিলেন। ২০২০ সালে চমেক হাসপাতালে ৪ মাস ৯ দিনের যুদ্ধ শেষে বাসায় ফিরেছিলেন অনীক, তা–ও পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় নয়। এর পর থেকে শিশুর মতো যত্নে তিল তিল করে পুরোনো অনীককে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন মনিকা।
মনিকা বলেন, অনীক এখনো ‘ফিট’ নয়। করোনার সময় থেকে দুই বছর স্টেরয়েড খেতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একটুতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মনিকা ২০২০ সালটি ভুলে থাকতে চাইলেও পারেন না। দুঃখ–শোকের বছর। ওই বছর ৩ মার্চ অনীকের বাবা অরুণ চন্দ বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান। দরজায় তখন কড়া নাড়ছে নতুন এক ভাইরাস করোনা। ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। চারদিকে আতঙ্ক। এরপর অনীকের ঘরের প্রত্যেক সদস্যই ভুগেছেন করোনার উপসর্গে। মা, দুই ছেলে, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইঝি—সবাই কমবেশি ভুগেছেন।
আগে থেকে অসুস্থ মা জয়শ্রী চন্দ ১ জুন জ্বর ও শ্বাসকষ্টের মতো করোনা উপসর্গ নিয়ে পরলোক গমন করেন। মায়ের শেষকৃত্য শেষে অনীক ৩ জুন হাসপাতালের কোভিড বিভাগে সেবা দিতে যান। অনীক নিজেও তখন অসুস্থ। পরে উপসর্গ বাড়তে থাকে। অসুস্থতার জন্য ১১ জুন মায়ের শ্রাদ্ধ করতে পারেননি তিনি। ১৩ জুন বাধ্য হয়ে চমেক আইসিইউতে ভর্তি হতে হলো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই ফল ভালো হলো না। শুরু হলো যমে মানুষে টানাটানি। সেটা এমন যে কয়েকবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৫০–এর নিচে নেমে গিয়েছিল। স্যাচুরেশন কমে গেলেও কোনোভাবেই অনীককে চোখ বন্ধ করতে দিতেন না মনিকা। বলতেন, ‘চোখ বন্ধ করবে না। চোখ বন্ধ করবে না। জেগে থাকার চেষ্টা করো।’
এই লড়াই ও সংগ্রাম শেষে বিধ্বস্ত অনীককে নিয়ে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর বাসায় ফিরেছিলেন মনিকা চন্দ। অক্সিজেন তখনো অনীকের নিত্যসঙ্গী। স্ত্রীর পাশাপাশি চমেকের চিকিৎসক ও সহকর্মীদের নিজের নতুন জীবন প্রাপ্তির কৃতিত্ব দেন অনীক। নিজের পাশের শয্যায় থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সমিরুল ইসলাম, সন্দীপন দাশের চলে যাওয়া দেখেছেন। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন তিনি।
দেড় বছরের বেশি সময় পর পুনরায় এক–আধটু করে হাসপাতালে রোগীর সেবায় ফিরেছিলেন অনীক চন্দ। কিন্তু জটিলতা পিছু ছাড়ে না। অনীক মেডিসিন বহির্বিভাগে রোগী দেখেন। প্রতিদিন শত শত নানা সংক্রমণের রোগী। অনীক বলেন, ‘আমার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একেবারে নেই। তাই যেকোনো রোগ তাড়াতাড়ি পেয়ে বসে। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী দেখি, ওখান থেকেই সংক্রমণ হয়। জ্বর ও অ্যাজমা লেগেই থাকে।’
তবু নতুন উদ্যমে বাঁচতে চান অনীক। তাই তো শারীরিক শত অসুবিধাকে তুচ্ছ করে অনীক বেরিয়ে পড়েন স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে। কাঁধে শখের প্রিয় ক্যামেরা। কখনো ছোটেন পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে, হ্রদের ধারে কখনো–বা হোলি উৎসবে রঙে রঙে রাঙিয়ে তোলেন নিজেকে। ঠিক রবীন্দ্রনাথের ভাবনার মতো—‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে, সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে। যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে।’