ইন্টারনেট বন্ধ রাখা সমর্থন করেন না ৯৪% মানুষ

প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৪ আগস্ট বিকেল

পর্যন্ত এই জরিপ চালানো হয়।

ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে গত ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে বেশ কয়েকবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। দেশে যে পরিস্থিতিই তৈরি হোক না কেন, কোনোভাবেই ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে নন ৯৪ শতাংশ মানুষ। প্রথম আলোর অনলাইন জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে।

জরিপে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। আর ২ শতাংশ পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মত দেননি। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৪ আগস্ট বিকেল ৫টা পর্যন্ত আট দিন প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে এই জরিপ চালানো হয়।

জরিপে প্রশ্ন করা হয়, ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা সমর্থন করেন কি?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলেছেন ৭১ হাজার ৪৮১ জন। অর্থাৎ তাঁরা ইন্টারনেট বন্ধের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৩ হাজার ১৭৬ জন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। এ ছাড়া ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনও সকালের দিকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।

জরিপে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’–এর পাশাপাশি ‘মন্তব্য’ নেই, এমন একটি ঘর ছিল। মন্তব্য নেই-এর ঘরে ভোট দিয়েছেন ৮৯৭ জন। ফেসবুকে পরিচালিত এই জরিপে অংশ নিয়েছেন ৭৫ হাজার ৫৫৪ জন। একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে গত জুলাই মাসে এবং চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে একাধিকবার ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে অনলাইনে এই জরিপ করেছে প্রথম আলো। এর আগে ১৪ থেকে ২০ আগস্ট প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আরেকটি জরিপ চালানো হয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। বিক্ষোভ ও ভিন্নমত দমনে বিভিন্ন সময়ে সরকারের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হতো। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্কভিত্তিক অ্যাকসেস নাউ ও ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম কিপইটঅন কোয়ালিশন গত মে মাসে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালে ছয়বার এবং ২০২৩ সালে তিনবার বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল।

এর আগে ১৪ থেকে ২০ আগস্ট প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আরেকটি জরিপ চালানো হয়।

তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল, তা বাংলাদেশে আর কখনোই ঘটেনি। টানা পাঁচ দিন (১৮ থেকে ২৩ জুলাই) পুরো দেশ ইন্টারবিহীন ছিল। এর মধ্যে গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত নয়টা থেকে পর্যায়ক্রমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল টানা ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। এ ছাড়া ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনও সকালের দিকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ১১ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে কারা জড়িত, তা তদন্ত করা হবে। ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকারের কোনো লোক, সংস্থা বা মন্ত্রী কেউ যদি জড়িত থাকেন, অবশ্যই বিচার করা হবে। ইন্টারনেটে অবাধে তথ্যপ্রবাহ হয়, এটি মানবাধিকার। কিন্তু এই ইন্টারনেট বন্ধ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, শত শত মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে।’

ইন্টারনেটকে মৌলিক ও মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যদি কোনো প্রয়োজনে ইন্টারনেট বন্ধ রাখতে হয় তবে কারণটি কী এবং কত সময় ধরে বন্ধ রাখা হবে, তা আগে থেকে জানাতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার

ইন্টারনেট বন্ধের কারণ হিসেবে বিগত সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ ইন্টারনেট অবকাঠামোয় (মহাখালীর ডেটা সেন্টার) অগ্নিসংযোগের দাবি করেছিলেন।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ঘটনা তদন্ত করার পর বলেছে, ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ইন্টারনেট বন্ধের পেছনে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নিজে এবং বিটিআরসি ও এনটিএমসি জড়িত। ডেটা সেন্টারের ঘটনা প্রচার করে জাতির সঙ্গে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মিথ্যাচার করেছেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ১৩ আগস্ট।

অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি এক চিঠিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে বলেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে এবং গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিতেন। বিগত সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করতে বাধ্য হয় বিটিআরসি।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকার সময় দেশের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা খাতে দিনে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

ইন্টারনেট বন্ধ রাখার বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেটকে মৌলিক ও মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যদি কোনো প্রয়োজনে ইন্টারনেট বন্ধ রাখতে হয় তবে কারণটি কী এবং কত সময় ধরে বন্ধ রাখা হবে, তা আগে থেকে জানাতে হবে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। কেউ যদি নীতিমালা ভঙ্গ করেন তাহলে তাঁকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।