বাবা বকবেন ভেবে মারধরের কথা গোপন করেছিলেন কাউসার

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ মোড় থেকে সরকারি কমার্স কলেজ সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে মোগলটুলী এলাকা। বাজারের পাশে গলি দিয়ে সামনে যেতেই হাজী গফুর টাওয়ার। ওই ভবনের তৃতীয় তলার দরাজাটা খোলা। ভেতরে ঘরভর্তি মানুষ। সবার চোখে-মুখে শোকের চিহ্ন। বসার ঘরে একটা বিছানার ওপর বসেছিলেন মুদিদোকানি আবদুল মোতালেব। ঘরে আসা প্রতিবেশী ও স্বজনদের উদ্দেশ্য করে বলছিলেন তিনি, ‘ছেলেটা এই বিছানায় ঘুমাইত। এখন বিছনাটা খালি’। বিছানায় হাত বোলাতে বোলাতে ফুপিয়ে উঠছিলেন বারবার। কাউসারের স্পর্শ যে এখনো লেগে আছে সেখানে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত আবদুল মোতালেবের ছেলে কাউসার মাহমুদের (২৩) মৃত্যু হয়। কাউসার চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসনের অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট এলাকায় আহত হন তিনি। দুই মাস ১০ দিন হাসপাতালে যুদ্ধ শেষে শেষ হার মেনে নেন তিনি।

কাউসার মাহমুদের পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায়। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরে মোগলটুলী এলাকায়। সেখানে বাবা, মা ও চার ভাই-বোন মিলে ভাড়া বাসায় থাকতেন তাঁরা। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে কাউসার সবার বড়। আজ মঙ্গলবার সকালে কাউসারের বিছানার পাশে বসে কথা হয় তাঁর বাবা আবদুল মোতালেবের সঙ্গে। মোতালেব বলেন, ‘ছেলেকে অমানুষের মতো মেরেছে তাঁরা। কিন্তু আমি বকব ভেবে মারধরের কথা গোপন করেছিল সে।’

আবদুল মোতালেব বলেন, ‘তাঁর ছেলে ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছিল। বাসার পাশে খাজা আজমেরি স্কুল থেকে তার শিক্ষাজীবন শুরু। সেখানে যখন কোনো পুরস্কার পেত, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এনে দেখাত। এরপর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি আর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট কলেজ থেকে এইএসসি পরীক্ষা দেয় সে। এরপর বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। আর্থিক অনটনের পরিবার, তাও ছেলের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতাম।’

গত ৪ আগস্ট নগরের নিউমার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের লোকজন। এ সময় পুলিশ দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। সেদিন কাঁদানে গ্যাস খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কাউসার। এরপর তাঁকে বেধড়ক মারধরের শিকার হন তিনি। তবে সেদিন পরিবারের কাউকে কিছু জানাননি তিনি। রাতে বাসায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড জ্বর আসে তাঁর। এর দুই দিন পর ৬ আগস্ট অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আবদুল মোতালেব বলেন, ‘আমার ছেলে মারধরের কথা কাউকে বলেনি। হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর শরীরের ক্ষত দেখতে পাই আমরা। এরপর সে স্বীকার করে, নিউমার্কেট এলাকায় সে মারধরের শিকার হয়েছে। অবস্থার অবনতি হলে ভর্তির পরদিনই কেবিন থেকে তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরীচর্যা কেন্দ্র) নিয়ে যাওয়া হয়।’

ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতি মনে করে আবদুল মোতালেব বলেন, ‘তার পুরো শরীরের জখমের দাগ ছিল। হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। একপর্যায়ে সে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারছিল না। আমাকেও চিনত না। মারধরের বিষয় জানার পর তাঁর বন্ধুরা যোগাযোগ করে। পরে সিভিল সার্জনসহ সরকারি কর্মকর্তারা আসেন।’

গত ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাউসার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানে এক দফা মেডিকেল বোর্ড বসে। এরপর তাঁকে চট্টগ্রামে সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। তবে অবস্থার অবনতি হলে আরেক দফা বোর্ড বসে। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সিএমএইচে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কাউসার।

কাউসারের বাবা আবদুল মোতালেব ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। আজ বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ মোগলঠুলী বাসায়
ছবি: জুয়েল শীল

গতকাল রাতে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের মাঠে জানাজা শেষে মোগলটুলী আবদুর রহমান মাতব্বর জামে মসজিদে পাশের কবরস্থানে কাউসার মাহমুদকে দাফন করা হয়েছে। রাতে তাঁর জানাজায় ছুটে যান কয়েক শ ছাত্র-জনতা। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী, তাঁর শিক্ষক, বন্ধু ও স্বজনেরা।

আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত রোববার রাত সাড়ে ৯টার আমাকে সেনাবাহিনী ফোন করে। তখন আমি ঢাকা মোহাম্মদপুর এলাকায়। তাঁর মাকে নিয়ে সিএমএইচে আসতে বলে। যাওয়ার পর তাঁরা আমার কাছে বাড়ির ঠিকানা জানতে চায়। বুঝতে পারি ছেলের অবস্থা ভালো নয়। পরদিন সে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। দুই মাস ১০ দিন হাসপাতালে যুদ্ধ শেষে আমি ছেলে লাশ নিয়ে ফিরলাম আমরা।’