বর্তমান কোম্পানি আইন (১৯৯৪ সালের) অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অনুপযোগী উল্লেখ করে হাইকোর্ট এক রায়ে আইনটি যুগোপযোগী করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ১৪ দফা পরামর্শ দিয়েছেন।
পরামর্শে অতি দ্রুত ভারতের কোম্পানি আইনের আদলে বাংলাদেশের কোম্পানি আইন সংশোধন করে নতুন কোম্পানি আইন প্রণয়ন ও প্রতিবছর আইন হালনাগাদ করতে, প্রতিটি জেলায় কোম্পানির সংখ্যানুপাতে এক বা একাধিক কোম্পানি আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং প্রতিটি বিভাগে একটি করে কোম্পানি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
টপ টেন ফেব্রিকস অ্যান্ড টেইলার্স লিমিটেড এবং টপটেন মার্টের ব্যবস্থাপনা ও শেয়ার নিয়ে করা দুটি আবেদন (কোম্পানি ম্যাটার) নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ২৫ আগস্ট রায় দেন। ২৩২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি চলতি সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ১৯৯৪ সালের এটিকে কোম্পানি আইন বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি পুরোটাই কোম্পানি আইন ১৯১৩ই রয়ে গেছে।…বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিতে হলে ১০৯ বছরের পুরোনো কোম্পানি আইন আমূল পরিবর্তন একান্তভাবে অপরিহার্য। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে কয়েক লাখ প্রাইভেট ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জন্য একটি কোম্পানি আদালত। অসংখ্য কোম্পানি বিরোধের জন্য একটি কোম্পানি বেঞ্চ থাকায় কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারলে কোম্পানিগুলো নিজে উন্নত হয়ে দেশকেও উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারবে। আধুনিক ও উন্নত বিশ্বের আদলে আমাদের কোম্পানি আইনকে ঢেলে না সাজালে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে।
রায় থেকে জানা যায়, মো. সৈয়দ হোসেন ১৯৯০ সালে একক মালিকানায় কাপড় ও সেলাইয়ের ব্যবসা শুরু করে এলিফ্যান্ট রোডে টপটেন নামে প্রথম শোরুম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর ছোট ভাই মো. উজ্জ্বল ও আবদুল আউয়ালকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ২০১১ সালে টপটেন মার্ট লিমিটেড কোম্পানি করে উজ্জ্বলকে ৩৫ শতাংশ এবং আউয়ালকে ৫ শতাংশ শেয়ার দেন। নিজে ৬০ শতাংশ শেয়ার গ্রহণ করেন।
তবে কোম্পানি পরিচালনায় মতের অমিল হওয়ায় উজ্জ্বল কোম্পানি আইনের ২৩৩ ধারায় (সংখ্যালঘু সদস্য বা শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার্থে) হাইকোর্টে ওই দুটি আবেদন করেন। আদালতে উজ্জ্বলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মারগুব কবির ও আব্বাছ উদ্দিন। সৈয়দ হোসেনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, মেহেদী হাসান চৌধুরী ও মুহাম্মদ হারুনুর রশীদ।
হাইকোর্ট বলেছেন, এই রায় ও আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি নামে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্ম দিয়ে আবেদনকারীর (উজ্জ্বল) শেয়ারের মূল্য যাচাই ও নির্ধারণ করতে হবে। শেয়ারমূল্য যাচাই ও নির্ধারণের পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আবেদনকারীর শেয়ার কিনে নিতে ২ নম্বর প্রতিপক্ষকে (বড় ভাই সৈয়দ হোসেন) নির্দেশ দেওয়া হলো।
কোম্পানি আইনটি ১০৯ বছরের পুরোনো হওয়ার কারণে ওই বিরোধের উদ্ভব হয় বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, কোম্পানি আইনের অধীন অপরাধের জন্য বিশেষ ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান করা হলো। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও কার্যসমূহের পরিদপ্তরকে (আরজেএসসি) আধুনিকীকরণ ও আইনি কাঠামো শক্তিশালী করতে এবং এর সেবার উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, করপোরেট ল কোড বাংলায় প্রকাশ করে প্রতিটি কোম্পানির অফিসে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকার ওপরে হলে প্রতিটি কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোম্পানি সচিব রাখা বাধ্যতামূলক করে (যারা আইসিএসবির সদস্য হবে) প্রয়োজনীয় পরিপত্র ইস্যু করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান করেছেন হাইকোর্ট।
রায়ে আদালত বলেছেন, কোম্পানির কার্যালয় যে শহরে নিবন্ধিত, সে শহরে এজিএম বাধ্যতামূলক করে দ্রুত পরিপত্র ইস্যু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পরামর্শ দেওয়া হলো। এজিএমে বা অন্য কোথাও কোম্পানির পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ধরনের উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ দেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে বিধি প্রণয়ন এবং এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিবন্ধন আপনাআপনি বাতিল মর্মে বিধি প্রণয়ন বিষয়টিও পরামর্শে এসেছে। এ ছাড়া লাভ-ক্ষতির হিসাব, উদ্বৃত্তপত্র, রিটার্ন বা করের বিষয় আরজেএসসিতে দাখিল করার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বিধিবিধান করা নিয়েও পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।