শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণ–অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা অগ্রভাগে ছিল বলে দাবি করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, ছাত্র–জনতার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যরাও এই বিপ্লবের অংশীদার। কিন্তু সবার ভূমিকা মানুষ হয়তো জানেও না। তাই তাঁদের কথা কেউ বলে না।
‘জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এবং বিপ্লবোত্তর ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা এ কথা বলেন। ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় যাতে কোনো প্রতিবিপ্লবের কারণে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের ব্যবহার করারও আহ্বান জানান বক্তারা।
শনিবার সকালে মহাখালীর রাওয়া কমপ্লেক্সে এই সেমিনারের আয়োজন করে রাওয়া রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি ফোরাম (আরআরএসএফ) ও রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)।
সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ এম মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এই গণ–অভ্যুত্থানে দুইভাবে ভূমিকা রেখেছেন। অবসরপ্রাপ্তরা সরাসরি মাঠে নেমেছেন এবং চাকরিরতরা চূড়ান্ত সময়ে অবদান রেখেছেন। আবু সাঈদ হত্যার পর সেনাবাহিনীর সব স্তরের সদস্যরা মাঠে নামেন। অবসরপ্রাপ্তরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিবাদ ও জনসংযোগ শুরু করেন। ১৮ জুলাই মিরপুর ডিওএইচএস থেকে প্রতিবাদের সূচনা হয়।
সশস্ত্র বাহিনী এখনো অবহেলিত জানিয়ে এ এম মোশাররফ বলেন, ‘সরকার পতনের এক মাস পার হলেও এখনো আমাদের বিষয়ে জানার আগ্রহ কারও নেই।’
ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে দেশ গড়ার নতুন সুযোগ হয়েছে উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিমুল গনি বলেন, দেশ সংস্কারকাজে চার জায়গা থেকে জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী এবং বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে সংস্কারকাজ করা সম্ভব। সশস্ত্র বাহিনীতে বিভিন্ন খাতে দক্ষ অবসরপ্রাপ্ত চার হাজার জনবল আছে। তিনি বলেন, বিগত সরকার সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এখনো প্রতিবিপ্লবের জন্য টাকা ছড়ানো হচ্ছে।
ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক লেফটেন্যান্ট (অব.) এ আর এম শহিদুল ইসলাম (আবু রূশ্দ) বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সক্রিয় করার প্রয়োজনীয় কাজগুলো হচ্ছে না। গত ১৫ বছরে এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ে যত বেসামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হয় বিশেষ একটি জেলা থেকে অথবা ছাত্রলীগের কর্মীদের বেছে বেছে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সেমিনারের অতিথি বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী কায়দায় তিনবার ক্ষমতা নেওয়া একটি দল। আর এটার পুরো পরিকল্পনা করেছে ভারত।’
আরেক অতিথি বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কীভাবে বাংলাদেশের এই বিপ্লবকে অস্থির করে তোলা যায়, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা যায়; এ জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশকে লাপাত্তা করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আনসার দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। হাসপাতালে রোগীদের সেবা বন্ধ করে দিয়েও একটা চেষ্টা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, সীমান্তের ওপার থেকে অহরহ উসকানি আসছে।
তবে মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার পক্ষে বড় কিছু করা সম্ভব নয়। তারা বিভিন্নভাবে ছোট ছোট গোলযোগ সৃষ্টি করে মানুষের মন বিষিয়ে তুলতে পারে। এ জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সেমিনার সঞ্চালনা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান। উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) হাসিনুর রহমান, লে. কর্নেল (অব.) শাহাদাত, মেজর (অব.) শফিকসহ চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁরা বিগত সরকারের সময় অন্যায়ভাবে যাঁদের সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাঁদের চাকরিতে পুনর্বহাল এবং পদোন্নতিবঞ্চিতদের পদোন্নতি নিশ্চিত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে অন্যায়–অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও তুলে ধরেন।