গণিত দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়
চলতি বছর গণিত উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। তাদের নিয়ে প্রথমে ‘অনলাইন বাছাইপর্ব’ এবং বাছাইপর্বের বিজয়ীদের নিয়ে ১৮টি আঞ্চলিক উৎসব হয়। আঞ্চলিকের বিজয়ী ১ হাজার ৩৫০ জনকে নিয়ে ১–২ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় গণিত উৎসব ২০২৪’। জাতীয় গণিত উৎসবের বিশেষ আয়োজন নিয়ে লিখেছেন বায়েজিদ ভূঁইয়া
ঘুড়িরা উড়িছে বন মাথায়।
হলুদে সবুজে মন মাতায়।
আবুল হোসেনের ‘ঘুড়ি’ কবিতার আবহের দেখা মিলল ২২তম ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসবের প্রাঙ্গণে। ১ মার্চ রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে মনমাতানো আবহ। মাথার ওপর নিশান আর রঙিন ঘুড়ির ওড়াউড়ি। লাল-নীল-সবুজ রঙের টি–শার্টে শিক্ষার্থীদের মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি। আর মাঠের একপাশে দেখা যায় ভারমুক্ত অভিভাবকদের অপেক্ষা। দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরা সেই সাতসকালে হাজির হয় উৎসব মাঠে। ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগান সামনে রেখে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসির পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি ২২তম বারের মতো এ উৎসবের আয়োজন করে।
উদ্বোধনী আয়োজন
দেশের শিক্ষার্থীদের গণিতে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে আয়োজিত হচ্ছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড। সকাল আটটা থেকে উৎসবস্থলে অঞ্চলভিত্তিক বুথে শুরু হয় আঞ্চলিক উৎসবের বিজয়ী শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন কার্যক্রম। সকাল ৯টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জাতীয় গণিত উৎসব। বেইলি রোডের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব। উদ্বোধনী পর্বে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সংখ্যায় সংখ্যায় এবারের আয়োজন
চলতি বছর সারা দেশ থেকে ১৭ হাজার ৪৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। এর মধ্যে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে ২০ শতাংশ, জুনিয়রে ৩৩ শতাংশ, সেকেন্ডারিতে ২৪ শতাংশ ও হায়ার সেকেন্ডারিতে ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রায় ৩৭ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে, যা কিনা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে প্রায় ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো অংশ নেয়। এবার সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন করেছে ঢাকা জেলার ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ছোট জেলার মধ্যে গাজীপুর থেকে ২ শতাংশ । আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি নটর ডেম কলেজ, আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ ও সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে গড়ে ৫০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী নাম নিবন্ধন করে।
গণিতের প্রত্যয়ে সাংস্কৃতিক যত আয়োজন
উৎসবের দ্বিতীয় দিন সমাপনী আয়োজনে অংশ নেয় মেরিল বেবি–প্রথম আলো বর্ণমেলায় ‘দেশের গানে মাতিয়ে দাও’ প্রতিযোগিতার বিজয়ী সাত শিশুশিল্পী। তারা জাতীয় সংগীত ও অমর একুশের গান পরিবেশন করে। উৎসবে ছিল থিয়েটার কোরিওগ্রাফির দল ‘কাদামাটি’ দেশাত্মবোধক পরিবেশনা। আরও ছিল মুখ দিয়ে নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ করে বিটবক্সিং করা ‘বিটমসফিয়ার’-এর দল। ‘গণিতের পট’ নিয়ে মঞ্চে আসেন খুলনার ‘রূপান্তর থিয়েটার’–এর শিল্পীরা৷
মেধা–বুদ্ধির যত আয়োজন
সুডোকু ও রুবিকস মেলানোর আয়োজন ছিল সবার জন্য। মাত্র ৮ দশমিক ৫০ সেকেন্ডে রুবিকস কিউব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষার্থী মুনতাজিম বিল্লাহ। সেরা গণিত ক্লাবের সম্মান পেয়েছে রাঙামাটির ‘ক্রিয়েটিভ সায়েন্স সোসাইটি’। আর ছিল মন ভালো রাখার কৌশল জানাতে মনের বন্ধুর বিশেষ কর্মশালা ও গণিতের প্রশ্ন তৈরি নিয়ে বিশেষ আয়োজন ছিল ‘তোমার প্রশ্ন, তোমার উত্তর’। শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রশ্ন তৈরি করে জমা দিলে আগামী গণিত উৎসবে তা প্রশ্ন হিসেবে দেওয়ার সুযোগ ছিল এবারের আয়োজনে। দুই দিনব্যাপী বইমেলা আয়োজন করা হয় উৎসব প্রাঙ্গণে।
রঙিন উৎসবে স্বেচ্ছাসেবক ও অভিভাবকেরা
গণিত উৎসব শুধু যেন শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, অভিভাবকদেরও অলিম্পিয়াড। গণিত উৎসবকে কীভাবে আরও বড় করা যায়, তা নিয়ে অনেক অভিভাবক গণিত অলিম্পিয়াড কমিটিকে অনেক সুপারিশ করেন। গণিত উৎসবের দুই দিন একাডেমিক ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল প্রায় ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগামীর খুদে গণিতবিদদের উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পান।
নতুন প্রত্যয়ে প্রস্তুতির ভাবনা নিয়ে বাড়ি ফেরা
গণিত অলিম্পিয়াডে শিক্ষার্থীরা নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ পায়। খুলনা গণিতবিদের বন্ধুত্ব হয় সিলেটের গণিতবিদের সঙ্গে। উৎসব প্রাঙ্গণে নানা জেলার শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্ব রঙিন আমেজ তৈরি করে। উৎসবের দ্বিতীয় দিন দুপুরে বিজয়ীদের এক এক করে মঞ্চে ডাকা হলো। দেশবরেণ্য গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, লেখক ও আলোকিত মানুষেরা শিক্ষার্থীদের পরিয়ে দেন মেডেল ও টি–শার্ট। যাদের নাম মাইকে ঘোষণা করা হয়, তাদের চোখে–মুখে দেখা যায় নতুন প্রত্যয়। আর যাদের নাম ঘোষণা করা হয়নি, তারা বন্ধুদের উৎসাহ দিয়ে করতালি দিতে থাকে। বন্ধুদের সাফল্যে নিজেকে আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত করার প্রত্যয় নেয় বাকিরা। নিজেদের তৈরি করার প্রত্যয়ে সবাই আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি পথে পা বাড়ায়।