দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ফারাক। জনকল্যাণমুখী, সস্তা ও বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য দেশের তুলনায় তলানিতে। এত কম বিনিয়োগ করে দরিদ্র ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ‘সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’ ফোরাম আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত উঠে এসেছে। বৈঠকে চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিরা অংশ নেন। বৈঠকে একজন চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বলতেও লজ্জা লাগে, দেশে যত খাত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় স্বাস্থ্য খাতে।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘নতুন অভিযাত্রায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য–সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কম থাকা, প্রশাসনিক সুশাসন না থাকা, দুর্নীতি ও অনিয়ম, চিকিৎসকদের মধ্যে বিভক্তি ও মূল্যবোধের অভাব, রোগীর পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় টানা, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অতিরিক্ত লাভের চিন্তা, ধনী ও দরিদ্র ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবায় বৈষম্য কল্যাণমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
সূচনা বক্তব্যে ‘সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’ ফোরামের সদস্যসচিব চিকিৎসক শামীম হায়দার তালুকদার জানান, ছাত্র–জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূলমন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ‘সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’ ফোরাম গঠিত হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ যেমন মানসম্মত সেবার অভাব, গ্রাম ও শহরে বৈষম্য, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, অসংক্রামক রোগের (এনসিডি) ক্রমবর্ধমান চাপ, স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব নিয়ে আলোচনা এবং যৌক্তিক সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে ফোরাম।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ফোরামের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যান্য দেশের তুলনায় তলানিতে। এত কম বিনিয়োগ করে কীভাবে দরিদ্র ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়? স্বাস্থ্যসেবা ভালো করতে পারলে চিকিৎসা ও ওষুধের মানও বাড়বে। চিকিৎসকের চেয়ে নার্স ও নার্সের চেয়ে প্যারামেডিক বেশি থাকা উচিত। অথচ দেশে শুরুতেই শুধু চিন্তা করা হয় চিকিৎসক বাড়ানোর জন্য।
বৈঠকে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কথা বলেন মাদ্রাসাছাত্র সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ ও স্কুলশিক্ষক মো. নেসারউদ্দিন। যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে তাঁরা বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সরকারের আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত। গ্রামের অনেক আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিতে পারছেন না। অনেকে ঋণ করে, খেয়ে না খেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
প্যানেল আলোচনায় সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ ফোরামের সদস্য চিকিৎসক মো.আব্দুস শাকুর খান বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ফারাক। এ খাতে বরাদ্দ কম। প্রশাসনিক সুশাসন নেই। এসব চ্যালেঞ্জ আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এই ব্যবধান ঘোচানো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করা দরকার।
দেশে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়ে রোগীরা দুরবস্থার সম্মুখীন হন বলে জানান ফোরামের আরেক সদস্য চিকিৎসক শরফুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা হতে হবে জনকল্যাণমুখী, সুলভ, সাশ্রয়ী ও বৈষম্যহীন। বলতেও লজ্জা লাগে, দেশে যত খাত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় স্বাস্থ্য খাতে।’
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে ভেঙেচুরে সাজাতে হবে। ওষুধ ও স্বাস্থ্যনীতি নতুন করে তৈরি করতে হবে।
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি ফারহানা দেওয়ান এবং বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক শবনম আক্তার সেবা দেওয়ার মাধ্যমে রোগীদের সন্তষ্ট করা ও রোগী যেন চিকিৎসক ও নার্সের কাছে দুর্ব্যবহারের শিকার না হন, তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছে। সংস্কার করতে চাইলে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ওষুধ ও জনসংখ্যা—এই চার নীতিতে হাত দিতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কৃষি, খাদ্য ও পানি।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, এ দেশে স্বাস্থ্য খাত কখনো তৈরিই হয়নি। তাই সংস্কার না করে নতুন করে কীভাবে শুরু করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
মুক্ত আলোচনায় স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা ও সংস্কার নিয়ে আরও কথা বলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের ভিজিটিং প্রফেসর স্বপন আদনান, আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী সামস্ এল আরেফিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক চিকিৎসক জাহিদুর রহমান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মেডিকেল দলের সদস্যসচিব তারেক রেজা, অধ্যাপক মতিউর রহমান মোল্লা, অধ্যাপক আবদুল জলিল চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন প্রমুখ।
গোলটেবিল আলোচনা সঞ্চালনা করেন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ ফোরামের সদস্য চিকিৎসক সাখাওয়াৎ হোসেন। সমাপনী বক্তব্য দেন ফোরামের আহ্বায়ক চিকিৎসক কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর।