চট্টগ্রাম কলেজ : সাড়ে ছয় বছর পড়ে আছে ছাত্রাবাস

২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের পর বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ছাত্রাবাস ও দুটি ছাত্রীনিবাস। বাড়তি খরচে শিক্ষার্থীরা থাকছেন মেসে।

ছাত্রাবাসের কক্ষের ভেতরের অবস্থা এখন এমনই জীর্ণ। ধুলো জমেছে আসবাবে। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম কলেজের শের–এ–বাংলা ছাত্রাবাসে
ছবি: প্রথম আলো

তিনতলার শের-এ-বাংলা ছাত্রাবাস। ঢোকার পথেই ঝোপঝাড় জমে গেছে। জানালার গায়ে জড়িয়ে আছে ময়লা। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভেতরে উঁকি দিলে উৎকট গন্ধ নাকে লাগে। ৯৬ বছর আগে তৈরি হওয়া ভবনটির দেয়ালজুড়ে শেওলা পড়ে গেছে। এখন জীর্ণ দশা হলেও একসময় শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর ছিল এটি। কিন্তু সাড়ে ছয় বছর ধরে হলটি একেবারে নিষ্প্রাণ পড়ে আছে। কোনো শিক্ষার্থীর পায়ের ছাপও পড়েনি এতে।

শুধু শের-এ-বাংলা ছাত্রাবাস নয়, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদের আরও দুটি ছাত্রাবাস ও দুটি ছাত্রীনিবাসের মূল ফটকে এখন তালা ঝুলছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে দেয়াল। চৌকি, চেয়ার, টেবিল, পানির কল, শৌচাগার—সব নষ্ট হয়ে গেছে অযত্নে। তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে এগুলো।

ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের দাবির মুখে এসব স্থাপনার ফটকে তালা ঝোলানো হয়। এরপর কেটে গেছে সাড়ে ছয় বছর।

ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম অনেকটাই গুটিয়ে গেছে। কিন্তু ছাত্রাবাসগুলো খুলে দিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো শিক্ষার্থী। বাড়তি খরচে ভোগান্তি সয়ে তাঁরা থাকছেন মেসে।

সম্প্রতি কলেজে গিয়ে কথা হয় স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগের ১০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে দুজনের বাড়ি চকরিয়া, দুজনের ফটিকছড়ি, তিনজনের আনোয়ারা, দুজনের বাঁশখালী ও একজনের পটিয়া। তাঁরা সবাই বাড়তি খরচে চকবাজার এলাকায় বিভিন্ন মেসে থাকছেন। খাবার ও থাকা মিলিয়ে গড়ে তাঁদের খরচ হয় ছয় হাজার টাকা।

তাঁদের মধ্যে আবদুর রউফ, হালিমুল ইসলাম ও সাইমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রাবাস চালু হলে থাকার খরচটা লাগত না। খাবারের খরচও কম হতো। সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকার মধ্যেই মাসের খরচ হয়ে যেত।

কলেজ সূত্র জানায়, শের-এ-বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে আসন রয়েছে ১২০টি করে মোট ২৪০টি, আবদুস সবুর ছাত্রাবাসে ১৮০টি। শের-এ-বাংলা ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৬ সালে, সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৫ ও স্যার আবদুস সবুর ছাত্রাবাস ১৯৯৮ সালে। আর ছাত্রীদের হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ছাত্রীনিবাসে ৮০টি ও জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রীনিবাসে ১০০টি আসন রয়েছে। সব মিলিয়ে আসন রয়েছে ৬০০টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রীনিবাসে এখনো কোনো শিক্ষার্থীর থাকার সুযোগই হয়নি।

ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস খুলে দেওয়ার বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোজাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘাতের শঙ্কা থাকায় ছাত্রাবাসগুলো খুলে দিতে নিরাপদ বোধ করছি না। কিন্তু ছাত্রীনিবাসগুলো ঠিকঠাক রয়েছে। তাই এগুলো খুলে দিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখব।’ অধ্যক্ষ বলেন, ছাত্রদের শের-এ-বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। বাকিগুলো সংস্কার করে চালু করা যাবে।

নগরের চকবাজার এলাকায় চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬ বছর আগে, ১৮৩৬ সালে। সে সময় চট্টগ্রাম জিলা স্কুল হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠা পায়। পরে ১৮৬৯ সালে একে উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত করা হয়। তখন থেকেই এটি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ বা চট্টগ্রাম কলেজ নামে পরিচিতি পায়।

এ কলেজ থেকে পড়ে গেছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ থেকে শুরু করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিরা। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার। উচ্চমাধ্যমিকসহ (বিজ্ঞান ও মানবিক শাখা) ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। শিক্ষক আছেন ১৫৬ জন।

কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশক থেকে চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রশিবির আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্রলীগ ধীরে ধীরে কলেজে প্রবেশ করে। তবে সংগঠনটি আধিপত্য ধরে রাখে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০১৬ সাল থেকে প্রকাশ্যে ছাত্রশিবিরকে আর তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি বলে দাবি করেছে ছাত্রলীগ।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কলেজে প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির না থাকলেও আশপাশে সংগঠনটি এখনো সক্রিয়। ছাত্রাবাস খুলে দিলে সেখানে সংগঠনটি আবার তাদের নৈরাজ্যমূলক কার্যক্রম শুরু করতে পারে। তাই যাচাই করে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের আসন দিতে পারলে, এসব ছাত্রাবাস খুলে দেওয়া যায়।

তবে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস চালুর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনি নিজেও চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। সিকান্দার খান বলেন, স্থাপনাগুলো জরাজীর্ণ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।