যেকোনো মূল্যে ইসি নির্বাচন করতে চায়
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সিইসিসহ কমিশনারদের সাক্ষাৎ। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ভোট করতে বদ্ধপরিকর নির্বাচন কমিশন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে চায়। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বপ্রস্তুতি শেষ করেছে তারা। এখন শুধু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা বাকি আছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করে আনলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এখনো নিশ্চিত হয়নি।
প্রশ্ন আছে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েও। তবে সেটাকে আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপির ডাকা অবরোধের মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি জানাতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর বঙ্গভবনের সামনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, যেকোনো মূল্যে আগামী ২৯ জানুয়ারির আগেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। দ্রুতই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।
রাষ্ট্রপতিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি অবহিত করেছেন জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘আমরা জানিয়েছি, আমাদের ওপর যে সাংবিধানিকভাবে দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে; বাধ্যবাধকতা, সে অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে বদ্ধপরিকর। সে বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও জনগণের সহযোগিতা কামনা করে যাচ্ছি।’
তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা যেকোনো মূল্যে অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও চারজন নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও যুগ্ম সচিব মাহাবুবার রহমান সরকার তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে হয়। চলতি একাদশ সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
ভোটের তফসিল আগামী সপ্তাহে
ইসি সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। আর ৬ থেকে ৯ জানুয়ারির মধ্যে ভোট করার চিন্তা করছে কমিশন। তবে ভোটের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তফসিল কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে। কিন্তু ভোট পেছানোর কোনো চিন্তা ইসির নেই।
ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করেছে ইসি। সারা দেশে ভোটকেন্দ্রের খসড়াও প্রস্তুত করা আছে। তফসিলের পর ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করা হবে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, কয়েক ধরনের সিলসহ নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের বেশির ভাগ ইতিমধ্যে জেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর কখন কোন কাজটি করা হবে, তা-ও চূড়ান্ত করা আছে। নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়াল (নির্দেশিকা) ছাপানোরও কাজ চলছে।
তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী কর্মকর্তা (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) নিয়োগ ও তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষক হিসেবে যাঁরা প্রশিক্ষণ দেবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) এক ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আজ শুক্রবার থেকে আরেক ধাপে এসপি ও ডিসিদের দুই দিনের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াসহ কিছু সুবিধা যুক্ত করে একটি নতুন নির্বাচনী অ্যাপ উদ্বোধন করা হবে আগামী রোববার। আর প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হবে ব্যালট পেপার ছাপানোর কাজ।
আগামী নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কারা দায়িত্ব পালন করবেন, তা এখনো ঘোষণা করেনি ইসি। সাধারণত জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়। গত বছর ইসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিশিষ্টজনদের অনেকে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ইসির একটি সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে কাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হবে, তা নিয়ে কমিশনের ভেতর মতভিন্নতা রয়েছে। ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার পক্ষে মত জোরালো। অবশ্য এই মতের বিপক্ষে একটি যুক্তি কমিশনে তোলা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রিটার্নিং কর্মকর্তা কাদের করতে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। কিন্তু আইনের একটি ধারায় বলা আছে, ভোটের তারিখের প্রজ্ঞাপন (তফসিল) প্রকাশের পর থেকে ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ১৫ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার (ডিসি), পুলিশ সুপাররা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আইনে বলা হয়েছে, ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তা করবেন। অর্থাৎ আইনের স্পিরিট বা চেতনা হলো ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা হবেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিটার্নিং কর্মকর্তা করার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে মতভিন্নতা অনেকটা ক্ষোভের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। অবশ্য এখন সেটা প্রশমিত হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা কাদের করা হবে, তা তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে ঠিক করা হবে। তবে অতীতের মতো ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার সম্ভাবনাই বেশি। কিছু আসনে নিজেদের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।
ভোটের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলো। অন্যদিকে চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। ফলে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, তা আরও জোরালো হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৪ নভেম্বর নিবন্ধিত ৪৩টি দলকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি। বিএনপিসহ ১৭টি দল ইসির আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। যে ২৬টি দল আলোচনায় অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকটি দল নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলে আসছে, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না।
প্রথম দিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে কিছুটা সংশয়ের কথা বললেও বিএনপির আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা নির্ধারিত সময়ে ভোট করতে বদ্ধপরিকর। গত ২৯ অক্টোবর হরতাল ও এরপর থেকে তিন দফায় ছয় দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। চতুর্থ দফায় আগামী রোববার ও সোমবার অবরোধ ডেকেছে দলটি।
তবে প্রতিকূল পরিবেশ হলে নির্বাচন হবে না, এমন ভুল-বোঝাবুঝি যেন জনগণের ভেতর না থাকে, সেটি গত ৩১ অক্টোবর স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেদিনও তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হবে। এরপর গতকাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পর সিইসি আবারও বললেন, যেকোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবে।
বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে নির্বাচন করতে এবার ভোটের সময় ২০১৪ সালের চেয়েও নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টি ভাবছে ইসি। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে এবং ভোটকেন্দ্রের বাইরে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবার মোতায়েন থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর পক্ষ থেকেও ইসিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, ২০১৪ সালের তুলনায় এখন তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। তাদের জনবল যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব, সেটা ঠিক। তবে সে সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি—বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন, সহিংসতা, দল ভাঙার অপচেষ্টা, এটি কোনোভাবেই নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ নয়। এমন পরিস্থিতিতে ইসি যদি নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয়, তাহলে তাদের ওপর যে সাংবিধানিক দায়িত্ব, সেটা ক্ষুণ্ন হবে। এর মাধ্যমে দেশকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।