সাপ নিয়ে ভুল ধারণা বেশির ভাগ মানুষের
ছোট থেকে বড়, সব বয়সী মানুষের মধ্যে সাপের প্রতি বিরূপ মনোভাব ও ভুল ধারণা রয়েছে। সাপ নিয়ে মানুষের ধারণা সংক্রান্ত একাধিক জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে একধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ সাপের দংশনে ইতিমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সাপ নিয়ে গুজবও আছে প্রচুর। এই গুজবের পেছনে সাপ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার একটা সম্পর্ক আছে-এমনটাই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
যে দুই জরিপের কথা বলা হলো, সেগুলো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে। এর মধ্যে ‘হিউম্যান পারসেপশনস টুওয়ার্ড হারপেটোফোনা ইন নর্থ ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্পিবিয়ান অ্যান্ড রেপটাইলস সাময়িকীতে।
এ জরিপ হয় ২০১৯ সালে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী জেলায়। সেখানে সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী নিয়ে মানুষের সাধারণ ধারণার কথা জানার চেষ্টা করা হয়। এতে অংশ নেন ২৩৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। দেখা যায়, ৮৮ শতাংশ মানুষই সাপকে ভয় পান। ৯৭ শতাংশ মনে করেন, সাপমাত্রই বিষধর প্রাণী। সাপকে মেরে ফেলা একটা ভালো কাজ বলে মনে করেন ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা। কৃষিজীবী নন, এমন ব্যক্তিরা কৃষকদের চেয়ে সাপ মারতে বেশি উৎসাহী। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতদের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি সাপ মারতে আগ্রহী।
দুটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো. ফজলে রাব্বী।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উভচর ও সরীসৃপ নিয়ে মানুষের ধারণা এবং বিভিন্ন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলোর আন্তসম্পর্ক দেখতে চেয়েছি আমরা গবেষণায়। জরিপের মাধ্যমে সেখানকার লোকজনকে সরীসৃপ সম্পর্কে সচেতন করা এবং দ্বন্দ্ব কমানোর চেষ্টাও ছিল আমাদের।’
সাপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভুল ধারণা
সাপের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোভাব কেমন, এ-সংক্রান্ত এক জরিপভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে এশিয়ান জার্নাল অব এথনো বায়োলজিতে। গবেষণার জন্য জরিপ হয় ২০১৯ সালে রাজশাহী, রংপুর ও নাটোরের বিভিন্ন এলাকায়। এতে অংশ নেন ৩৪৮ জন শিক্ষার্থী।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, সাপ ও অন্যান্য সরীসৃপ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন সাপ নিজে থেকে মানুষকে আক্রমণ করে, এটি একটি প্রচলিত ভুল ধারণা। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩১৩ জন (৯০ শতাংশ) এটি বিশ্বাস করেন। অন্যান্য অনেক কুসংস্কারের মধ্যে আছে, সাপ দুধ পান করে, সাপের মাথায় মণি থাকে, সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে, সাপের পা থাকে, সাপের গায়ে চুল থাকে, সাপ বিনের শব্দে নাচতে পারে ইত্যাদি। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৬ শতাংশের বেশি সাপকে দেখেই মেরে ফেলার কথা বলেছেন।
৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সাপকে আঘাত করলে এই প্রাণী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। অথচ এ ধারণা পুরোপুরি ভুল।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে আলোচনা ও ভুল ধারণা
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। এ নিয়ে গুজব বেশি ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কোথাও চন্দ্রবোড়া সাপ মনে করে অন্য সাপকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই মনোবৃত্তির পেছনে শিক্ষা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই মূল বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, আঘাত না করলে সাপ বা কোনো প্রাণীই মানুষকে আক্রমণ করে না। সাপ যেটা করে, তা নিতান্তই আত্মরক্ষার্থে। আসলে মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণীই অকারণে অন্য প্রজাতিকে আঘাত করে না।
যেকোনো বন্য প্রাণী দেখলে তার ওপর নৃশংস আচরণের মূলে আছে লোকায়ত অপবিশ্বাস, অজ্ঞতা, পাঠ্যক্রমে এসব প্রাণী সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব। অনেক বইপত্রে প্রাণিকুল সম্পর্কে নেতিবাচক বা ভুল তথ্য তুলে ধরা হয়। এসব বইপত্র শিশুমনে প্রভাব ফেলে। তাই এসব সংবেদনশীল বিষয় সম্পর্কে লিখতে এসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতকে নিয়োজিত করা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
সাপের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে স্থানীয় জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের (বন দপ্তর) সম্মিলিত উদ্যোগ এবং গণসচেতনতা কার্যক্রম নেওয়া দরকার-দুই গবেষণাতেই এ কথা বলা হয়েছে।