চট্টগ্রামে ১৮ হাজারের গৃহকর বেড়ে লাখ টাকা, বাতিলের দাবি

একসময়ের সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম শহরে এখন গড়ে উঠছে সারি সারি বহুতল ভবন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়ায় পাঁচতলা ভবন রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী মতিউর রহমান চৌধুরীর। ভবনে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। একটিতে পরিবার নিয়ে নিজে থাকেন। বাকি সাতটি ভাড়া দেন। তবে বছরের সব সময় ফ্ল্যাটে ভাড়াটে থাকে না। এই ভবনের জন্য তিনি আগে বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে গৃহকর দিতেন ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়নের পর তাঁর বার্ষিক গৃহকর ১ লাখ ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে সিটি করপোরেশন।

আগের তুলনায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি এই কর পরিশোধের জন্য চলতি মাসে তাঁকে নোটিশ দেওয়া হয়। এই নোটিশ পেয়ে তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। এক লাফে গৃহকর লাখ টাকার কাছাকাছি বেড়ে যাওয়ায় দিশাহারা তিনি। বাসাভাড়ার টাকা থেকে সংসার চালান। তিনি ও স্ত্রী অসুস্থ। দুজনের চিকিৎসার টাকাও ব্যয় করা হয় ভাড়ার টাকা থেকে।

গৃহকর নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা মতিউর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগে ভবনের আয়তনের ভিত্তিতে গৃহকর নেওয়া হতো। এখন ভাড়ার ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে গৃহকর অনেক বেড়ে গেছে। অথচ বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বাড়তি। পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে নিজেদের অসুস্থতা রয়েছে। সবকিছুর খরচ সামাল দিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। যদিও কর কমানোর জন্য আবেদন করেছেন। কতটুকু কমে, তা তো জানা নেই।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে করা পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম আন্দোলনের মুখে স্থগিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিতাদেশ তুলে নেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখন সে গৃহকর আদায় কার্যক্রম শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার পর ভবনমালিকদের ঠিকানায় পাঠানো হচ্ছে গৃহকর পরিশোধের নোটিশ। আর নোটিশ পেয়ে মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো বিপাকে পড়েছেন নগরের অনেক ভবনমালিক।

ভবনমালিকেরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের অধিকাংশ ভবনমালিক ভাড়ার টাকার ওপর নির্ভরশীল। সিটি করপোরেশন গৃহকর বৃদ্ধি করলে এর চাপ পড়বে ভবনমালিক ও ভাড়াটে দুই পক্ষের ওপরেই। তখন ভাড়া বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না ভবনমালিকদের। অপর দিকে বাড়তি ভাড়া দিতে গিয়ে চাপে পড়তে হবে ভাড়াটেদের।

সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগে ভবনমালিক ও ভাড়াটেরা যখন চাপে পড়তে যাচ্ছেন, তখন এই পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। মঙ্গলবার নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে স্মারকলিপি দিয়েছে সংগঠনটি। পর্যায়ক্রমে বাকি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলেও এই কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রথম মাঠে নেমেছিল এই সংগঠন।

যোগাযোগ করা হলে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন গৃহকর নিয়ে যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে নজর আছে। ভবনমালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ বোর্ডে গৃহকর সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করার জন্য মেয়রের নির্দেশনা মানা হচ্ছে। তবে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের স্মারকলিপির বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় ২০১৭ সালে কর পুনর্মূল্যায়নের পর বার্ষিক কর নির্ধারণ করা হয় ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পুরোনো নিয়মে ওই দাবি ছিল ৩৪৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। নতুন কর পুনর্মূল্যায়নের পর সরকারি খাতে হোল্ডিং দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪৭টিতে। এর বিপরীতে বার্ষিক দাবি ছিল ২৮০ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ১ লাখ ৮২ হাজার ৭০০ হোল্ডিংয়ের বিপরীতে বার্ষিক দাবি ধরা হয় ৫৭১ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

তবে এই কর পুনর্মূল্যায়নের বিরুদ্ধে করদাতা সুরক্ষা পরিষদসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছিল। আন্দোলনের মুখে পড়ে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর তা স্থগিত করে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে এই কর পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম আর বাস্তবায়িত হয়নি।

সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে করা স্থগিতাদেশ গত ১৮ জানুয়ারি প্রত্যাহার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত জুলাই থেকে তা কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় সিটি করপোরেশন। পুনর্মূল্যায়নের পর গত মাস থেকে ভবনমালিকদের নোটিশ দেওয়া শুরু হয়।

তবে সে কার্যক্রম বাতিলের দাবি জানিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে উত্তর আগ্রাবাদ, পশ্চিম মাদারবাড়ি, উত্তর পাঠানটুলী, এনায়েত বাজার, পাঠানটুলী, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ও দক্ষিণ আগ্রাবাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের নেতারা। আগামী শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী মোড়ে জনসভার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ আমির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর নিয়ে ভোগান্তি চট্টগ্রামবাসীর পিছু ছাড়ছে না। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের মানুষও দিশাহারা। বছরের অর্ধেক সময় সড়ক পানিতে ডুবে থাকে। নালা-নর্দমায় পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট, পয়োনিষ্কাশন ও সড়কবাতির বেহাল দশা। ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও গৃহকর আদায়ের তোড়জোড় রয়েছে। অথচ বর্তমান মেয়র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গৃহকর না বাড়ানোর। কিন্তু এখন যে গৃহকর বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা পরিশোধ করা অসহনীয় হয়ে যাবে। নতুন করে নির্ধারণ করা গৃহকর বাতিল করতে হবে।