৪১ হাজার ফুট উঁচুতে লাফ দেওয়া আশিক
বুঝলাম, শরীরের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, শুধু পাখার মতো ঘুরছি
বিশ্ব রেকর্ড গড়তে ৪১ হাজার ৭৯৫ ফুট উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে শূন্যে লাফ দেওয়া আশিক চৌধুরী বলেন, ‘এবারের লাফের আগের ৫০টি লাফের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। আমার অবস্থাটা ছিল অনেকটা এমন যে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছি অথচ পুকুরে পানি নেই। সেখানে শুধু বাতাস। বিমান থেকে লাফ দিয়ে বুঝলাম, শরীরের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শূন্যে শুধু ফ্যানের পাখার মতো ঘুরছি।’
পেশায় ব্যাংকার আশিক চৌধুরী বলেন, স্কাইডাইভিংয়ের সময় হাতে জাতীয় পতাকা না থাকলে এ লাফ দেওয়াটা অনেক সহজ হতো। কিন্তু দুই হাতে ধরা বাংলাদেশের পতাকাটা বলা যায় প্রায় মহাশূন্যে উড়েছে। অনন্য উচ্চতায় পতাকাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
আজ রোববার রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির (ইউসিবি) কার্যালয়ে ইউসিবি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আশিক চৌধুরী তাঁর অভিযানের কথা তুলে ধরেন। বিশ্ব রেকর্ড গড়ার এ অভিযানে স্পনসর বা আর্থিক সহযোগিতা করেছে বেসরকারি এই ব্যাংক। আশিকের পাশে সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো।
আশিক চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসে বিমান থেকে লাফ দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা চালান গত ২৫ মে। তাঁর এ প্রচেষ্টা সেখানে উপস্থিত থেকে তত্ত্বাবধান করেছেন ওয়ার্ল্ড এয়ার স্পোর্টস ফেডারেশনের এক বিচারক। আকাশে রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ডের রেকর্ড পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাটি সম্প্রতি আশিকের লাফের বিস্তারিত পরিসংখ্যান তাঁকে পাঠিয়েছে।
আশিক চৌধুরী ৮ জুন প্রথম আলোকে জানান, ওয়ার্ল্ড এয়ার স্পোর্টস ফেডারেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তিনি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের দুটি শাখায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। শাখা দুটি হলো ‘লংগেস্ট আউটডোর ফ্ল্যাট ফ্রি ফল’ ও ‘গ্রেটেস্ট ডিসটেনস ফ্রি ফল উইথ আ ব্যানার/ফ্ল্যাগ’। শিগগিরই এ আবেদন জমা দেবেন আশিক।
ওয়ার্ল্ড এয়ার স্পোর্টস ফেডারেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪১ হাজার ৭৯৫ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে লাফ দেন আশিক। ৩৭ হাজার ২৯৭ ফুট উচ্চতায় নেমে আসার পর জাতীয় পতাকা মেলে ধরেন। এরপর ২ মিনিট ৫০ সেকেন্ড পতাকা ধরে রাখেন। ৪ হাজার ৪৯৮ ফুট উচ্চতায় আসার পর ভূমিতে অবতরণের জন্য তাঁর পিঠে থাকা প্যারাস্যুট খোলেন আশিক।
সংবাদ সম্মেলনে আশিক বলেন, ‘স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা যাবে না। আমাদের সামনে হয়তো অনেক উদাহরণ নেই। উদাহরণ নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। কেননা, দেশটা তো আমাদের। বিদেশে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি নিজেদেরই গড়তে হবে।’
আশিক জানান, তিনি দেশে ফেরার পর অনেকেই তাঁর খোঁজখবর নিয়েছেন। এক বন্ধু ফোন করে বলেছেন, তাঁর মেয়ে কথা বলতে চায়। অন্য ছোট বাচ্চারাও ফোন করেছে। এভাবেই আগামী প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে হবে। পঞ্চগড়ের একটা ছোট ছেলে যদি মনে করে চাঁদে যাওয়া সম্ভব, তবে তাকে উৎসাহিত করতে হবে যে এটা সম্ভব।
সিঙ্গাপুরে বহুজাতিক দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) রিয়েল অ্যাসেট ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন আশিক। অফিস সিঙ্গাপুরে হলেও মাসের বড় একটা সময় কাটে বাংলাদেশ ও ভারতে। আশিক চৌধুরীর এই রেকর্ড গড়ার উদ্যোগের নাম ‘দ্য লার্জেস্ট ফ্ল্যাগ ফ্লোন ইন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার’। ভূপৃষ্ঠ ছাড়িয়ে ১০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের মধ্যবর্তী জায়গাকে বলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। আশিক রেকর্ড গড়তে প্রায় সাত বর্গফুট আকারের পতাকা নিয়ে লাফ দেন, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে এযাবৎ ওড়ানো সবচেয়ে বড় পতাকা।
সংবাদ সম্মেলনে আশিক চৌধুরী এ অভিযানে আর্থিক সহযোগিতা করায় ইউসিবি কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অন্য যাঁরা তাঁর মতো এমন অভিযানে যেতে চান, তাঁদের সৎসাহস থাকলে ইউসিবিকে পাশে পাওয়া যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন। আর তিনি যে রেকর্ড করেছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই কেউ এ রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়বেন বলেও প্রত্যাশার কথা জানান।
ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ কাদরী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউসিবি সব সময় এমন উদ্যোগের সঙ্গে থাকে। এতে কত খরচ হবে বা কতটুকু প্রচার পাওয়া যাবে, তা চিন্তা করে না। ইউসিবিকে বুকে ধারণ করে আশিক চৌধুরী বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করায় তিনি আশিক চৌধুরীকে ধন্যবাদ দেন।
সংবাদ সম্মলনে আশিক তাঁর মা–বাবা, স্ত্রী, দুই ছেলে–মেয়েসহ স্বজনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের সহায়তা ছাড়া এত বড় অভিযান চালানো সম্ভব হতো না। বিশেষ করে স্ত্রী নাবিলা খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, তিনি সংসার আগলে রেখেছেন বলেই এমন অভিযানে যাওয়া আশিকের পক্ষে সহজ হয়েছে।
রেকর্ড গড়তে গত ২১ মে রাতে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে উড়াল দেন আশিক চৌধুরী। এরপর এয়ারফিল্ডে দুই দিন অনুশীলন করেন। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় পূর্বনির্ধারিত (২৫ মে) সময়েই রেকর্ডের প্রচেষ্টা চালান তিনি। বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ সাধারণত ৩৫ হাজার ফুটের নিচ দিয়ে চলাচল করে। এর ওপরে উঠতে দরকার হয় বিশেষায়িত বিমান। পাইপার শাইয়ান টার্বো ৪০০ এলএস বিমান দিয়ে আশিক রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মেমফিসের উইংস ফিল্ড বিমানঘাঁটিতেই এ ধরনের বিশেষ বিমান পাওয়া যায়। সেখানকার আবহাওয়াও এই রেকর্ড গড়ার জন্য অনুকূল।
আশিক চৌধুরীর বাড়ি চাঁদপুরে। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর বেড়ে ওঠা যশোরে। স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। ২০০৭ সালে স্নাতক হয়েই যোগ দেন দেশের একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেছেন। তারপর পড়তে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানেই ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম স্কাইডাইভিং করেন।
যুক্তরাজ্যে এক বছর এই প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর প্রাইভেট পাইলট হিসেবে লাইসেন্স পান আশিক চৌধুরী। এরপর থাই স্কাই অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির অধীনে স্কাইডাইভিংয়ের ওপর লম্বা প্রশিক্ষণ নেন। গত বছর অর্জন করেন স্কাইডাইভারের লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দেখিয়ে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া বিশ্বের যেকোনো দেশে স্কাইডাইভিং করতে পারবেন আশিক।