আন্দোলনে শহীদদের কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন শিক্ষার্থীরা

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় সংঘর্ষের চিত্র। এমন সংঘর্ষ হয়েছে দেশের নানা জায়গায়ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এই সরকার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি বিপ্লবী সরকার। বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। পরিপূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আহতদের সুচিকিৎসা দিতে হবে। হত্যাকাণ্ড, হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। নিরপেক্ষতার কথা বলে পতিত স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের সুবিধাভোগীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

আজ শনিবার বেলা ১১টায় ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘মৃত্যুর মুখোমুখি: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকরীদের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে শিক্ষার্থীরা এসব কথা বলেন। এতে সমাপনী বক্তব্য দেন মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক মো. মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, যে দেশে সাহসী তরুণসমাজ গুলির সামনে বুক পেতে দেয়, সঙ্গীর মৃত্যুতেও পালিয়ে যায় না, সে দেশে আর কোনো স্বৈরশাসন ফিরে আসতে পারে না।

ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক মনির হায়দার। প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী ওয়েবিনারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছয় শিক্ষার্থী আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় তাঁদের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের অভিজ্ঞতা, নির্যাতন, হামলা এবং পরিবারের ওপর আওয়ামী লীগ, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার চাপের কথা তুলে ধরেন। কেউ কেউ স্মৃতিচারণার সময় সহযোদ্ধার শহীদ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। কেউ বলেছেন আহত হওয়ার পর সেসব ভয়ংকর দিনের মানসিক যন্ত্রণার কথা।

ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম শাহরিয়ার বলেন, তিনি প্রথম থেকেই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পরে জুলাইয়ের মাঝামাঝি আন্দোলন বেগবান হলে তিনি সমন্বয়কদের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিছিল-সমাবেশের স্লোগানের দলে ছিলেন। আন্দোলনে অংশ না নিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকেন। রাজশাহীর চারঘাটে পুলিশ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তাঁর গ্রামের বাড়ি গিয়ে কলেজশিক্ষক বাবাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে, তিনি যেন ছেলেকে আন্দোলন করতে নিষেধ করেন। এমনকি চাকরি চলে যাওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়।

ফাহিম বলেন, ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের নেতারা দুই দিনের মধ্যে তাঁকে হল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে তিনি হল ছেড়ে বিভিন্ন বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন। বিজয় ৭১ হলের আটতলা থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে ফুলের টব নিক্ষেপ করা হয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বাঁচলেও আহত হন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল আজিজ উত্তরা এলাকায় আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি ওই এলাকায় আন্দোলনের সময়ের অবস্থার কথা তুলে ধরেন। ১৭ জুলাই তাঁর মাথার পেছনে গুলি লেগে খুলির একটি অংশে ভেঙে যায়। কানেও গুরুতর আঘাত পান। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নিউরোসার্জন ছিলেন স্বাচিপের নেতা। তিনি তাঁকে চিকিৎসা দিতে সম্মত হননি। পুলিশ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে গভীর রাতে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। ওই দিন আজিজের এক সহযোগী গুলিতে শহীদ হন।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম আবর্তনের (ব্যাচ) ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মমতাজ সোমা বলেন, শহীদ আবু সাঈদ তাঁদের ব্যাচের আবর্তনেই শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সাঈদ যেদিন (১৬ জুলাই) শহীদ হন, সেই দিন ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ এবং তাদের ভাড়াটে অস্ত্রধারীদের তাণ্ডবের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বিবরণ তুলে ধরেন তিনি।

মমতাজ সোমা বলেন, ছাত্রীরা একপর্যায়ে সেদিন বিকেলে হলে ফিরে এলে হলের রেজিস্ট্রার অস্ত্রধারী তিন বহিরাগতকে হলে ঢুকিয়ে দেন। তারা ছাত্রীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর সেই রেজিস্ট্রারকে তাঁর পদ থেকে অন্য বিভাগে স্থানান্তর করা হলেও তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। এমনকি ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষকেরা এখনো আগের মতোই সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। তাহলে এত আত্মত্যাগ, এত রক্তদানে কী পাওয়া গেল।

যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার হাফেজ মো. কামরুল হাসান খান বলেন, মাদ্রাসার ছাত্রদের সবাই দূরে রাখতে চায়। কিন্তু এই আন্দোলনের শুরু থেকেই বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্ররা অংশ নেয়। তিনি পথে সক্রিয় ছিলেন। ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে তাঁদের মিছিলে পুলিশ গুলি করলে তাঁর সামনেই একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তিনি জীবন বাঁচাতে সেই মরদেহের ওপর মৃত্যুর ভান করে পড়ে থাকেন। পরে ভ্যানে করে মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার সময় ভ্যানচালকের সহায়তায় তিনি পালাতে সক্ষম হন।

বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়েম খান বলেন, তাঁদের বাসা থেকে রাজপথের গুলির শব্দ শোনা যেত। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সময় তাঁর মা আতঙ্কে থাকতেন, না জানি কখন ছেলের মৃত্যুর খবর আসে।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী তৌফিক আহমদ অল্পের জন্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, তাঁর এক সহযোদ্ধার শরীরে ১৬৫টি ছররা গুলি লেগেছিল। কয়েকটি বের করা হয়েছে, এখনো শতাধিক গুলি তাঁর শরীরে রয়েছে। আরেক শিক্ষার্থীর চোখে গুলি লেগেছে। তাঁরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। আহত ব্যক্তিরা এখনো সুস্থ হননি। অথচ এরই মধ্যে তাঁদের কথা ওপরের স্তরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ভুলতে বসেছেন। এটা বিপ্লবী সরকার। বহু মানুষের আন্দোলনে গঠিত হয়েছে। নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বিপ্লবের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার ব্যক্তিদের উপেক্ষা করা চলবে না।

ওয়েবিনারের শেষ দিকে অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার জন্য ২০২২ সালে এই প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়েছিল। এত শিগগিরই স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটবে, তা তাঁরা প্রত্যাশা করেননি। তিনি আশা করেন, এই অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য যে সংস্কার, সেই কাজটি অন্তর্বর্তী সরকার সঠিকভাবে করুক। একই সঙ্গে আহতদের সুচিকিৎসা এবং দোষী ও বিগত স্বৈরশাসকের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।