সুস্বাদু আম আনছে সুসময় 

আমের বাজার ১২ হাজার কোটি টাকার। আমের বাগান করা, কেনাবেচা ও পরিবহনে যুক্ত বহু মানুষ। পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে কর্মসংস্থান হচ্ছে। 

আম নিয়ে হাটে এসেছেন বাগানিরা। সম্প্রতি রাজশাহীর পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে
ছবি: প্রথম আলো

আম সুস্বাদুই নয়; বহু মানুষের জীবনে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুসময় এনেছে আম।

রংপুরের তরুণ মেহেদী হাসানের (২৮) কথাই বলা যাক। বছর আটেক আগে ঢাকায় এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। পরে সে চিন্তা বাদ দিয়ে গ্রামে ফিরে যান। ভর্তি হন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকার সময়ই (২০১৫) বাবার এক একর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাগান করেন। 

এখন মেহেদির নিজের ও জমি ইজারা নিয়ে করা আমবাগান রয়েছে ১৪ একরের। সব বাগানে এখনো আম ধরা শুরু হয়নি। তারপরও এ বছর আম বিক্রির পরিমাণ ২০ লাখ টাকায় দাঁড়াবে বলে আশা করছেন। ব্যয় হবে পাঁচ লাখ টাকার মতো। মেহেদির বাগানে স্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করেন তিনজন। সারা বছরই ১০ থেকে ১৫ জন অস্থায়ী কর্মী লাগে তাঁর।

বাংলাদেশের আমের অর্থনীতি ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ, দেশে উৎপাদিত অন্য ফলমূলের তুলনায় আমের বাজার ব্যবস্থাপনা, কৃষিসেবা ও পরিবহনব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
গাছে ঝুলছে এক থোকা গোপালভোগ আম
ফাইল ছবি

মেহেদীর বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আম রংপুরের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। আমের মৌসুমে এই অঞ্চলে সবাই কাজ করেন, সবাই আয় করেন। আশপাশের জেলা থেকে মানুষ আসেন কাজের জন্য। তরুণেরা অনলাইনে আম বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ জোগান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাবে, এ বছর দেশে আমের উৎপাদন দাঁড়াবে সাড়ে ২৪ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি কেজির খুচরা দর ৫০ টাকা ধরলে এই পরিমাণ আমের দাম দাঁড়ায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আম যত কেনাবেচা হয়, তত বাজারে টাকা ঘোরে। শুধু আমবাগানের মালিক বা ব্যবসায়ী নন, সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত বহু মানুষের আয়ের উৎস এই আম।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে জনপ্রিয়তার কারণে আমের উৎপাদন–এলাকা সম্প্রসারিত হচ্ছে, নতুন নতুন জাত আসছে, আম হয়ে উঠছে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের আমের অর্থনীতি ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ, দেশে উৎপাদিত অন্য ফলমূলের তুলনায় আমের বাজার ব্যবস্থাপনা, কৃষিসেবা ও পরিবহনব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উৎপাদনের হিসাব ভিন্ন। তাদের হিসাবে দেশে বছরে ১২ লাখ টনের মতো আম হয়। কলার উৎপাদন আমের চেয়ে কম (৮ লাখ টন)। 

আম এক নম্বরে, দামও কম

ফল উৎপাদনের হিসাব করা হয় দুই ভাগে। অস্থায়ী বাগান ও স্থায়ী বাগান ধরে। স্থায়ী বাগানে উৎপাদিত ফলের মধ্যে আম এখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়। ডিএইর হিসাবে এর পরিমাণ ২৪ লাখ টনের মতো। এর পরে রয়েছে কাঁঠাল, উৎপাদিত হয় প্রায় ১৯ লাখ টন। অস্থায়ী বাগানের ফলের মধ্যে বেশি হয় কলা। সারা বছর ধরে দেশে প্রায় ৩০ লাখ টন কলা ফলে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উৎপাদনের হিসাব ভিন্ন। তাদের হিসাবে দেশে বছরে ১২ লাখ টনের মতো আম হয়। কলার উৎপাদন আমের চেয়ে কম (৮ লাখ টন)। 

আরও পড়ুন

দুই সংস্থার হিসাবই বলছে, প্রতিবছর আমের উৎপাদন বাড়ছে। এতে দামও মানুষের নাগালে আসছে। এ বছর মৌসুমের মাঝামাঝি ৫০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে আম পাওয়া গেছে। এখন মৌসুমের শেষ ভাগ। তবু ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন জাতের আম পাওয়া যায়।

আমের গড় দাম স্থিতিশীল থাকছে। কোনো কোনো বছর সেটি কমছেও। যেমন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৯ সালে ল্যাংড়া আমের গড় খুচরা দর ছিল ৮১ টাকা। ২০২১ সালে সেটি ৬৫ টাকায় নামে। 

দাম কম থাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো আম খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু ও পেঁয়ারার মতো বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বাড়ায় মানুষ ফল খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে পেরেছেন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। বিবিএসের খানা আয়–ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খেয়েছেন, যা ২০১০ সালে ছিল ৪৪ দশমিক ৭ গ্রাম। 

একসময় ভালো জাতের আমের এলাকা বলতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বোঝাত। আর আমের জাতের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল হিমসাগর, ল্যাংড়া ও ফজলি। এখন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে বেশি আম হয় নওগাঁয়। আর সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত জাত আম্রপালি। 

লাভজনক, তাই বাগান বাড়ছে

আমের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। বিপরীতে দাম ভালো পাওয়া যায়। ডিএইর হিসাবে, এ বছর এক কেজি আম উৎপাদনে গড়ে ব্যয় ২০ টাকা। বিপরীতে পাইকারি পর্যায়ে এক কেজি আম মান ভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। কোনো কোনো বাগানমালিক সরাসরি খুচরা বিক্রেতার কাছে আম বিক্রি করেন। তাঁরা দাম পান আরও বেশি।

ডিএইর কর্মকর্তারা জানান, একবার আমগাছ পরিণত হলে ৫০ থেকে ৬০ বছর ফল পাওয়া যায়। ফলে শুরুতে বেশি বিনিয়োগ দরকার হলেও পরে ব্যয় কমে যায়। এতে অনেকেই আমের বাগান করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। 

একসময় ভালো জাতের আমের এলাকা বলতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বোঝাত। আর আমের জাতের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল হিমসাগর, ল্যাংড়া ও ফজলি। এখন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে বেশি আম হয় নওগাঁয়। আর সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত জাত আম্রপালি। 

বাংলাদেশের অন্তত তিন আমের জাত বিশ্ববাজারে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা ও বারি-৪। ওই জাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এবং মান বজায় রেখে চাষ করলে বাংলাদেশ খুব দ্রুত বিশ্ববাজারে আম রপ্তানিতে জায়গা করে নেবে।
ডিএইর হর্টিকালচার শাখার সাবেক পরিচালক মো. কবির হোসেন

সাতক্ষীরা, রংপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন বিপুল পরিমাণে আম উৎপাদিত হচ্ছে। ডিএই বলছে, বাগানমালিকেরা এখন জনপ্রিয় জাতগুলোর পাশাপাশি নতুন বিভিন্ন জাতের আমের বাগান করছেন। বারি-৪, বারি-১১, কিং অব চাকাপাত, কিউজাই, বানানা ম্যাঙ্গো, তাইওয়ান গ্রিন, মিয়াজাকি অর্থাৎ সূর্যডিম ইত্যাদি রয়েছে নতুন জাতের তালিকায়। বারোমাসি আমের জাত কাটিমনের চারার বিক্রি বাড়ছে দ্রুত। 

ডিএইর হিসাবে, দেশে এখন প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে আমগাছ রয়েছে। গাছের মোট সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। উৎপাদন এলাকার সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন জাত আসায় এখন আমের মৌসুমও বিস্তৃত হয়েছে। দেশে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে আম উঠতে শুরু করে। পাওয়া যায় আগস্ট পর্যন্ত।

ডিএইর বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. মেহেদী মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যেসব নতুন এলাকায় আম চাষ হচ্ছে, সেখানে উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে আমের স্বাদ ও উৎপাদন বাড়ছে। 

দুটি উদ্যোগ দরকার

দেশে যেভাবে আমবাগান বাড়ছে, তাতে রপ্তানি বাজার ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বাজারবিশেষজ্ঞরা। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম কৃষিচর্চা বা গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (গ্যাস) অনুসরণ করা দরকার।

উত্তম কৃষিচর্চায় নিয়ম মেনে পরিমিতভাবে কীটনাশক, সার ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্রেতাদের নির্দেশিত শর্ত মানতে হয়। 

ডিএইর হর্টিকালচার শাখার সাবেক পরিচালক মো. কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অন্তত তিন আমের জাত বিশ্ববাজারে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা ও বারি-৪। ওই জাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এবং মান বজায় রেখে চাষ করলে বাংলাদেশ খুব দ্রুত বিশ্ববাজারে আম রপ্তানিতে জায়গা করে নেবে।