তুলনামূলক ভালো আবহাওয়ার কারণে এবার ঈদুল ফিতরের দিন ভালোভাবেই কাটছিল। বড় ধরনের কোনো খারাপ খবর ছিল না। কিন্তু হঠাৎ বিকেলে এতে ছেদ ঘটায় রাজধানীর সদরঘাটের খবরটি। একটি লঞ্চের ধাক্কায় আরেকটি লঞ্চের ছিঁড়ে যাওয়া মোটা রশির আঘাতে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে পোশাকশ্রমিক বিল্লাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে ছিল আরও একজন। যে পৃথিবীর আলো না দেখার আগেই এই ঘটনায় বিদায় নিয়েছে। নিহত বিল্লালের স্ত্রী মুক্তা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
কেউ কেউ দুর্ঘটনা বললেও এটি মোটেও কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি অন্যায় চর্চার ফল। একই নৌপথে চলাচল করা বিভিন্ন মালিকের লঞ্চগুলোর মধ্যকার ঠেলাঠেলি মর্মান্তিক এই ঘটনার জন্য দায়ী বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। আর সদরঘাটের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত লঞ্চ দুটির যাত্রী টানতে বেপরোয়া চলাচলের কথা অনেকেরই জানা।
একটু লক্ষ করলে দেখবেন, ঈদের দিন সদরঘাটে যে ঘটনাটি ঘটল, এর সঙ্গে একই নৌপথে চলাচল করা দুটি লঞ্চ জড়িত। এর একটি এমভি তাসরিফ-৪ ও অপরটি এমভি ফারহান-৬। লঞ্চ দুটি ঢাকা থেকে ভোলার দক্ষিণের উপজেলা চরফ্যাশনের বেতুয়া পর্যন্ত চলাচল করে। এই নৌপথের যাত্রীরা জানেন, এমভি ফারহান-৬-এর মালিকপক্ষে রয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। ফারহানের পাশাপাশি টিপু নামেও তাঁর একাধিক লঞ্চ রয়েছে। অপরদিকে তাসরিফ লঞ্চের মালিকপক্ষ দেশের একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের সঙ্গে ভোলা-২ আসনের (বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান) বিএনপির সাবেক একজন সংসদ সদস্যের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তাসরিফ লঞ্চের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোলার বাসিন্দা।
ঘটনার মূল যেখানে
বেতুয়া থেকে কয়েক বছর আগে ঢাকায় এমভি তাসরিফের কয়েকটি লঞ্চ চলাচল শুরু করে। এতে এই নৌপথে শুরুর দিকে বড় ধরনের ধাক্কা খায় গোলাম কিবরিয়ার মালিকানাধীন লঞ্চগুলো। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল-দীর্ঘদিন ধরে নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলার মনপুরা, বেতুয়া, তজুমদ্দিন, হাকিমুদ্দিন, দৌলতখান প্রভৃতি নৌপথে একক আধিপত্য ছিল গোলাম কিবরিয়ার মালিকানাধীন লঞ্চগুলোর। তাদের যাত্রীসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ ছিল প্রতিদিনকার ঘটনা। বিভিন্ন উৎসবে কোম্পানি কেবিন ও স্টাফ কেবিনের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ভাড়া কয়েক গুণ আদায় করা, লঞ্চের ডেকে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা ইত্যাদি অভিযোগ ছিল।
ফারহান ও টিপু লঞ্চের এসব অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করলে ক্ষমতার দাপটে তাঁর উল্টো পরিণতির শিকার হওয়ার নজির রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৬ নভেম্বর কোরবানির ঈদের ছুটিতে ভোলার দৌলতখানে টিপু লঞ্চ থেকে এক যাত্রীকে পিটিয়ে মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। কয়েক দিনের মাথায় ওই যাত্রীর লাশ ভেসে ওঠে। অভিযোগমতে, লঞ্চটি ঢাকা থেকে ভোলার দৌলতখানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা পুনরায় যাত্রী নেওয়ার জন্য যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে না দিয়ে জোর করে ভোলার ইলিশা ঘাটে নামিয়ে দেয়। সময়ের ব্যবধানে দৌলতখান থেকে ইলিশার দূরত্ব নৌ ও সড়ক-উভয় পথে এক ঘণ্টার মতো। এতে অন্য যাত্রীরা নেমে গেলেও ওই যাত্রী এর প্রতিবাদ করে লঞ্চে বসে থাকেন। পরে তাঁকে ওই পরিণতি ভোগ করতে হয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে তখন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে সে সময় বিষয়টি জাতীয়ভাবে ততটা আলোচিত হয়নি। কারণ, একই দিন (২০০৯ সালের ২৬ নভেম্বর) ভোলার লালমোহনের নাজিরপুরে বিএনপির চেয়ারপারসনের পরিবারের মালিকানাধীন কোকো-৪ লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছিল। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৮১ জনের প্রাণহানি হয়। তখন এ ঘটনা কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। তাতে অনেকটাই চাপা পড়ে যায় টিপু লঞ্চের ঘটনাটি।
এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে টিপু ও ফারহান নামের লঞ্চগুলো নিয়ে যাত্রীদের ক্ষোভ ছিল। পরে তাসরিফ লঞ্চ চালু হলে যাত্রীদের একটা বড় অংশ এই লঞ্চে যাতায়াত শুরু করে। পাশাপাশি এই লঞ্চের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্যের আত্মীয়তার বিষয়টিও তাসরিফ লঞ্চের যাত্রী পেতে সাহায্য করে। এ ছাড়া লঞ্চের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোলার হওয়ায় সেটিও যাত্রীদের সঙ্গে তাদের একটি বাড়তি যোগাযোগের পথ তৈরি করে দেয়।
ফলে এই নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা জানেন, এমভি তাসরিফ ও ফারহান নামের লঞ্চগুলোর মধ্যে এমন রেষারেষি বহুদিন ধরে চলে আসছে। কে কার আগে যাত্রী নেবে, কে যাত্রীদের কতভাবে আকৃষ্ট করবে, কে কার আগে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবে-এসব বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিযোগিতা চলে তাদের মধ্যে। তবে এ উদাহরণ শুধু তাসরিফ বা ফারহানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বিভিন্ন নৌপথে অনেক লঞ্চের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রাণহানির ঘটনা এটাই প্রথম নয়
২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি এক ট্রলারডুবিতে ৯ যাত্রীর মৃত্যুর জন্য এই এমভি ফারহান-৬ লঞ্চের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় নৌ আদালতে করা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মামলা থেকে জানা যায়, বেতুয়া থেকে ছেড়ে আসা এই লঞ্চের একটি ইঞ্জিন পথে বিকল হয়ে যায়। তখন ঘন কুয়াশার মধ্যে এক ইঞ্জিন চালু রেখেই লঞ্চটি ঢাকার দিকে আসতে থাকে। ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার মোহনা পার হওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জ খেয়াঘাট এলাকায় লঞ্চটির সঙ্গে একটি যাত্রীবোঝাই ট্রলারের সংঘর্ষ হয়। এতে ট্রলারটি ডুবে ৯ যাত্রী প্রাণ হারান।
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাসরিফ-৪ লঞ্চটির ধাক্কায় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমুদ্দিন লঞ্চঘাটে বিলকিছ (৫৫) নামের এক যাত্রী নিহত এবং দুই যাত্রী আহত হয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, এরপরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে এই হাকিমুদ্দিন লঞ্চঘাটেই আরেকটি লঞ্চের ধাক্কায় পন্টুন থেকে মেঘনা নদীতে পড়ে হৃদয় নামের এক যাত্রী নিখোঁজ হন এবং ২৫ জনের মতো যাত্রী আহত হন। সেবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল বেতুয়া থেকে ঢাকা নৌপথে চলাচলকারী আরেক কোম্পানির লঞ্চ কর্ণফুলী-১৩। তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সে দিন কর্ণফুলী-১৩ লঞ্চটি ফারহানের লঞ্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঘাটে ভেড়াতে গেলে ওই ঘটনা ঘটে। এই দুটি ঘটনাতেই হাকিমুদ্দিন লঞ্চঘাটের পন্টুন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বেতুয়া থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো যেসব ঘাটে যাত্রী ওঠানামা করায়, তার মধ্যে হাকিমুদ্দিন একটি।
সদরঘাটে এমন ঘটনা আরও
১. এবারের মতো ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরের ছুটির মধ্যেও ঢাকার সদরঘাটে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। সে বছরের ১ মে ঈদের ছুটি কাটাতে পটুয়াখালীতে যাওয়ার পথে ঢাকার সদরঘাটে এক পা হারান মো. কবির হোসেন নামের এক ব্যক্তি। পূবালী-১২ নামের লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চ ও পন্টুনের মধ্যবর্তী স্থানে পড়ে কবির তাঁর বাঁ পা হারান এবং একই ঘটনায় শাহজালাল নামের আরেকজনের পা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট দুই লঞ্চের মাঝখানে পড়ে দুই পা থেঁতলে গিয়েছিল রিয়াজ হোসেন নামের এক পোশাককর্মীর। তিনিও পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে পটুয়াখালী যাচ্ছিলেন। এরও কয়েক বছর আগে সদরঘাটে দুই লঞ্চের মাঝে পড়ে নিহত হয়েছিলেন ভোলার একটি বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক। যিনি একসময়ের স্বনামধন্য একটি বই প্রকাশনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ব্যবস্থা নিলে কি এসব চলত?
এখন প্রশ্ন হলো, সদরঘাট আর হাকিমুদ্দিনের এই দু-চারটি ঘটনাই কি লঞ্চের এই ধাক্কাধাক্কির উদাহরণ? অবশ্যই নয়। আর সদরঘাটের এ ঘটনা কি অন্ধকারে ঘটেছিল? তা-ও নয়। সদরঘাট ও নৌপথের সঙ্গে বিভিন্নভাবে অনেকগুলো কর্তৃপক্ষ জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), নৌ পুলিশ, থানা-পুলিশ, কোস্টগার্ড প্রভৃতি।
তাহলে এখন প্রশ্ন করাই যায়, সদরঘাটে সরকারি এতগুলো প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা থাকতে কেন এত অঘটন। তাহলে এদের কাজটা কী? এ নিয়ে প্রথম আলোর কথা হয় একটি লঞ্চ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি এক বাক্যে উত্তর দেন, লঞ্চের ধাক্কাধাক্কির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক অভিযোগই পড়ে থাকে। এবার প্রথম আলোর কাছে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘বলেন, যদি কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তাহলে এসব কি চলত?’
* মো. ছানাউল্লাহ, সহম্পাদক, প্রথম আলো