জ্বালানি তেল
ডিজেল আমদানিতে বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার
কম খরচে আমদানির জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে বিপিসি। ব্রুনেই থেকেও আমদানির চিন্তা। রাশিয়ার তেলও পরীক্ষা হচ্ছে।
দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। বছরে চাহিদা প্রায় ৪৬ লাখ টন, যার ৮০ শতাংশই সরকার সরাসরি আমদানি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম চড়া। বাড়তি দামে জ্বালানি তেল কিনতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়েও লোকসান কমাতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই কম খরচে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল আমদানির জন্য বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার। ইতিমধ্যে রাশিয়া, ব্রুনেই ও ভারতের সঙ্গে সরকার আলোচনা শুরু করেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বলছে, বর্তমানে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। আর পরিশোধিত তেল আসে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই নতুন উৎস থেকে ডিজেল আনতে আলোচনা শুরু করেছে সরকার।
তবে নতুন উৎসের মধ্যে ভারত থেকে আমদানি লাভজনক হতে পারে বলে মনে করছেন বিপিসির দায়িত্বশীল তিনজন কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম মোটামুটি সব জায়গায় একই থাকে। তফাত হয় প্রিমিয়ামে (জাহাজভাড়াসহ অন্যান্য খরচ)। বর্তমানে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেলে (১৫৯ লিটার) গড়ে ১০ ডলার প্রিমিয়াম দিতে হয় বিপিসিকে। ভারত থেকে আনার ক্ষেত্রে এটি ৮ ডলার হতে পারে। প্রতি ব্যারেলে ২ ডলার কমলেও ১ লাখ টনে প্রায় ১৫ লাখ ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। তাই ভারত থেকে আমদানি হলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সাশ্রয়ের চিন্তা মাথায় রেখেই জ্বালানি তেলের বহুমুখী উৎস খোঁজা হচ্ছে। বেশি উৎস থাকলে প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়া যায়। তবে নতুন উৎস কতটা সাশ্রয়ী, তা বোঝা যাবে জ্বালানি তেল আনা শুরুর পর।
■ ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড থেকে ডিজেল আমদানি নিয়ে আলোচনা চলছে। ■ রাশিয়ার জ্বালানি তেলের মান, ব্যবহারের উপযোগিতা, দাম, আনার খরচসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
গত মার্চে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ১৪০ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। একই সময়ে ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এটি কমে ১৩৪ ডলারে আসার পর দেশে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়। গত ৫ আগস্ট রাতে সরকার এক লাফে ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বৃদ্ধি করে। এতে এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়ে হয় ১১৪ টাকা। বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাওয়ার পর সরকার জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা সমন্বয় করে। দাম বাড়ার ২৩ দিনের মাথায় ২৯ আগস্ট ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। এখন প্রতি লিটার ডিজেল ১০৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শিগগিরই লিখিত প্রস্তাব দেবে ভারত
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল) থেকে ডিজেল আমদানি নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকায় আলোচনা করেছে বিপিসি। যেদিন প্রথম আলোচনা শুরু হয়, সেদিনই ভারত সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুই দিনের বৈঠকে অংশ নেওয়া বিপিসির দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। এ ক্ষেত্রে আইওসিএলের সক্ষমতার বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। শিগগিরই আইওসিএল লিখিত প্রস্তাব দেবে, এরপর আবার আলোচনা শুরু হবে। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আইওসিএল থেকে তেল আনা হয়েছিল, পরে তারা আর সরবরাহ করতে পারেনি।
গত মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেও জ্বালানি তেল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের জরুরি প্রয়োজনে ডিজেল সরবরাহ করার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। এর পরদিনই (গত বুধবার) জ্বালানি তেল সরবরাহকারী হিসেবে আইওসিএলকে তালিকাভুক্ত করেছে বিপিসি।
বর্তমানে ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে নিয়মিত পরিশোধিত জ্বালানি তেল আনে বিপিসি। ২০১৭ সাল থেকে ট্রেনে করে আসছে এ তেল। তবে বছরে এর পরিমাণ ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টনের বেশি নয়। এ রিফাইনারি থেকে তেল আনার পরিমাণ বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন। এ পাইপলাইন দিয়ে নুমালিগড় থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আসবে জ্বালানি তেল। এটির কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হতে পারে।
ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে রাশিয়ার তেল
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ল্যাবরেটরিতে রাশিয়া থেকে আসা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ল্যাবে পাওয়া তথ্য এখন যাচাই-বাছাই চলছে। এ সপ্তাহে বিপিসির কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
বিপিসি সূত্র বলছে, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তেলের মান, ব্যবহারের উপযোগিতা, দাম, আনার খরচসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখছে বিপিসি। দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে এক দফা বৈঠকে প্রাথমিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার পর রাশিয়ার তেল শোধনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এরপর দাম ও অন্যান্য খরচ নিয়ে আলোচনা হবে। এটি কতটা লাভজনক হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ব্রুনেইয়ে সম্ভাবনা খুঁজছে সরকার
এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্র ব্রুনেই থেকে ডিজেল আনার সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছে সরকার। ইতিমধ্যে দেশটির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রুনেইতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি কাজ করেন। জনশক্তি পাঠানো দেশটির সঙ্গে জ্বালানি আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় সরকার। গত ২৯ আগস্ট দুই দিনের জন্য ব্রুনেই সফর করে এসেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। আগামী অক্টোবরে দেশটির সুলতান হাজি হাসান আল বলকিয়ার ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। ওই সময় ডিজেল আমদানি নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে চায় সরকার। বিশ্ববাজারের চেয়ে কিছুটা ছাড়ে ব্রুনেই থেকে তেল পাওয়া গেলে আনার খরচসহ তা লাভজনক হতে পারে বলে মনে করছে বিপিসি।
দামের সঙ্গে পরিবহন খরচ নিয়েও চিন্তা
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বছরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) শোধন করে ডিজেল, পেট্রল, অকটেনসহ বিভিন্ন রকম জ্বালানি তেল উৎপাদন করতে পারে। বছরে ছয় লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করতে পারে তারা। নতুন উৎস থেকে অপরিশোধিত তেল আনার চেয়ে ডিজেল কেনায় বেশি আগ্রহ বিপিসির। তাই সবাইকেই ডিজেল সরবরাহের প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। তবে রাশিয়া এখন পর্যন্ত ডিজেল সরবরাহের লিখিত প্রস্তাব দেয়নি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, অপরিশোধিত তেলের চেয়ে এখন কম দামে ডিজেল আনাই লাভজনক। তবে রাশিয়া থেকে পরিবহন খরচ অনেক বেশি হবে। ব্রুনেই থেকে ডিজেল পাওয়া গেলে ভালো। আর ভারত থেকে ডিজেল আনার ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ সবচেয়ে কম পড়বে। তারা যদি দামে কিছুটা ছাড় দেয়, তাহলে এটা লাভজনক হতে পারে। যেখান থেকে দামে ছাড় পাওয়া যাবে এবং পরিবহন খরচও কম পড়বে, সেখান থেকেই ডিজেল আনা উচিত।