সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রকল্প: ভুয়া পেশাজীবী সাজিয়ে অর্থ আত্মসাৎ
শুধু ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিদের আড়ালে এক বছরে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকার বেশি।
একই সময়ে উপকারভোগীর তালিকায় নাম আছে, কিন্তু প্রশিক্ষণ পাননি, এমন ব্যক্তিদের আড়ালে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশি।
কাগজে-কলমে তাঁরা কামার, কুমার, নাপিত; কেউবা বাঁশ-বেতের পণ্য প্রস্তুতকারী। তবে বাস্তবে এসব পেশায় যুক্ত নন তাঁরা। মূলত দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পেশাজীবীদের জন্য বরাদ্দ থাকা উদ্যোক্তা মূলধন ও প্রশিক্ষণ ভাতা আত্মসাৎ করতে এমন ভুয়া পেশাজীবী বানানো হয়েছে তাঁদের।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’ প্রকল্পে হয়েছে এমন অনিয়ম।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ ভুয়া নাম-ঠিকানার আড়ালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে, ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা এবং উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য নিজেদের প্রান্তিক পেশাজীবী হিসেবে দেখিয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় তাঁদের পরিবারের নাম এসেছে। এ ছাড়া কাজ করতে গিয়ে অনেকের সুপারিশ রাখতে হয়েছে
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বংশগতভাবে বিভিন্ন আদি পেশাজীবী যেমন কামার, কুমার, নাপিত; বাঁশ-বেত পণ্য, কাঁসা-পিতলের পণ্য তৈরিকারী; জুতা মেরামত ও প্রস্তুতকারীদের (মুচি) জীবনমান উন্নয়নে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন জেলায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে তা শেষ হয়। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের অধীনে আদি ক্ষুদ্র পেশায় নিয়োজিত ২৭ জেলার ১১৭ উপজেলার ২৬ হাজার ৩৪৩ জনকে দীর্ঘমেয়াদি (৬ মাস) ও স্বল্পমেয়াদি (৩ দিন) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, একজন উপকারভোগী মূলধন হিসেবে ১৮ হাজার ও প্রশিক্ষণ ভাতা ৫ হাজার অর্থাৎ মোট ২৩ হাজার টাকা পাওয়ার কথা।
কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ পান ৩১৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১২৫ জন ছিলেন প্রকৃত প্রশিক্ষণার্থী (প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর)। মোট প্রশিক্ষণ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৩ জনের নাম-ঠিকানা ছিল ভুয়া। তাঁদের ঠিকানায় গিয়ে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। অন্যরা এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না (যেমন রাজনৈতিক নেতা, ধনী ব্যক্তি)। আর অন্তত পাঁচজনের নাম দুবার আছে তালিকায়।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্যমতে, লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় গত পাঁচ বছরে এ প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগী হন ৩ হাজার ৫০৪ জন। তাঁদের মধ্যে কালীগঞ্জে সুবিধাভোগী ১ হাজার ১১০ জন।
কত নেতা ভুয়া নাপিত, কামার, কুমার সেজে টাকা তুলে নিল। আমরা অরিজিনাল (প্রকৃত) ব্যবসা করি। অথচ ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) পাইনি।
তালিকায় ভুয়া নাম
কালীগঞ্জে নরসুন্দরের (নাপিত) প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে নাম ছিল সুমন, নয়ন, মলিন, সুদান, রোহিত ও নলিনী শীলের। তাঁদের বাড়ি দেখানো হয়েছে দলগ্রাম ইউনিয়নের দক্ষিণ দলগ্রাম গ্রামে। গ্রামটি ঘুরে তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ইউপি সদস্য কাবেজ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ দলগ্রামে কোনো নরসুন্দর নেই।
একইভাবে দক্ষিণ দলগ্রামের সুমন দাস, পুলিন দাস, অমল দাস ও কালভৈরব গ্রামের অনিল দাসের পেশা দেখানো হয়েছে মুচি। কালভৈরব বাজারে মুচির কাজ করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ভারত রবিদাস। তিনি ওই ব্যক্তিদের চিনতে পারেননি।
তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দলগ্রাম ইউনিয়নের মোট ৭৮ বাসিন্দার নাম সুবিধাভোগীর তালিকায় আছে। তাঁদের ৪৭ জনই ভুয়া। এ ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ মনিরুল ইসলাম, আবদুল মালেক ও মনোরঞ্জন কুমার ওই ব্যক্তিদের চিনতে পারেননি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সুমন আলীর মাধ্যমে অনলাইনে খুঁজে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরও ভুয়া।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সুবিধাভোগীর তালিকায় চলবলা ও মদাতী ইউনিয়নেও ১৬ ব্যক্তির ভুয়া নাম পাওয়া গেছে। প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছেন, তালিকায় ভুয়া নাম দিয়ে এ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, উপজেলা পর্যায়ে সুবিধাভোগী যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর সদস্যসচিব উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা। কালীগঞ্জের সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, সুবিধাভোগীর তালিকায় ভুয়া নাম রয়েছে, এমন অভিযোগ ঠিক নয়।
এ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. কামরুজ্জামান। তিনি দাবি করেন, উপজেলা কমিটি সুবিধাভোগীর তালিকা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করে। কোনো অনিয়মের ঘটনা তাঁর জানা নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিদের আড়ালে (অন্তত ৬৩ জন) এক বছরে (২০২০-২১) আত্মসাৎ করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া তালিকায় নাম আছে, কিন্তু প্রশিক্ষণ পাননি, এমন অন্তত ৩৫ জনের আড়ালে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশি।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ পান ৩১৫ জন। তাঁদের ৬৩ জনের নাম ও ঠিকানা ভুয়া।
তালিকায় সমাজকর্মীর পরিবার ও দলীয় নেতারা
কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের ফিল্ড সুপারভাইজার নাজমা বেগমের ভাই, তিন বোনসহ পরিবারের ছয়জনের নাম আছে বাঁশ ও বেতের পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকায়। নাজমা অবশ্য তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেন।
একইভাবে কারিগরি প্রশিক্ষক সুফিয়া আক্তারের ভাই, চাচা ও চাচির নাম আছে তালিকায়। সুফিয়ার দাবি, তাঁরা বাঁশ ও বেতের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তবে তাঁর চাচি বুলবুলি বেগম বলেন, তাঁরা এ প্রশিক্ষণ পাননি।
কাকিনা ইউনিয়ন সমাজকর্মী নাজমুল হাসানের স্ত্রীর নাম তালিকায় থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুলের দাবি, তাঁর স্ত্রী বাঁশ ও বেতের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
অফিস সহকারী পারভীন বেগমের স্বামী সাজু মিয়ার নাম কামারের আর বোন, ভগ্নিপতি, ভাগনির নাম রয়েছে বাঁশ ও বেতের প্রশিক্ষণার্থীর তালিকায়। সাজুর দাবি, কামার নয়; বাঁশ-বেতের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। তবে সাজুর প্রতিবেশীরা তাঁকে কখনো বাঁশের কাজ করতে দেখেননি বলে জানান।
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় তাঁদের পরিবারের নাম এসেছে। এ ছাড়া কাজ করতে গিয়ে অনেকের সুপারিশ রাখতে হয়েছে।’
আবার উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব হোসেনের নাম আছে নরসুন্দরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের তালিকায়। তাঁর দাবি, তিনি বেকার থাকায় প্রশিক্ষণ নেন।
গোড়ল ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি অমৃত কুমার ও সাধারণ সম্পাদক শংকর দয়াল রায় বাঁশ ও বেতের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। অমৃতের ওষুধের দোকান আছে। আর শংকর জানান, তিনি কৃষি ও মাছ চাষ করেন। ওই তালিকায় তাঁর নাম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগ্রহ থেকে করেছিলাম।’
নাম আছে, প্রশিক্ষণ নেই
প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম আছে গোড়ল গ্রামের সাইকেল মেকার সুনির্মল চন্দ্র রায় ও দরজি মুকুল চন্দ্রের। দুজনই বলেন, তাঁরা কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। তবে প্রশিক্ষণের জন্য ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি অমৃত কুমার তাঁদের কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নেন। অমৃতের দাবি, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে তিনি ওই কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।
সুনির্মল ও মুকুলের মতো সুবিধাভোগীর তালিকায় থাকা অন্তত ৩৫ ব্যক্তি কোনো প্রশিক্ষণ পাননি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তাঁদেরই একজন ভোটমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শিউলি বেগম। তালিকায় তাঁর নাম থাকার বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে জানিয়েছেন। যদিও সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালিকায় নাম আছে অথচ প্রশিক্ষণ পাননি, এমন অভিযোগ মিথ্যা।’ তাঁর দাবি, যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরাই কেবল প্রশিক্ষণোত্তর অনুদানের চেক পেয়েছেন।
কালীগঞ্জের ১৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবীর সঙ্গেও কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা উপকৃত হয়েছেন বলে জানান। তবে তাঁদের সবার অভিযোগ সুবিধাভোগী বাছাই নিয়ে। দলগ্রাম বাজারের নরসুন্দর পরেশ চন্দ্র শর্মা বলেন, ‘কত নেতা ভুয়া নাপিত, কামার, কুমার সেজে টাকা তুলে নিল। আমরা অরিজিনাল (প্রকৃত) ব্যবসা করি, অথচ ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) পাইনি।’