বাঙালি জাতিসত্তার স্মারক উত্সব

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ
প্রথম আলো ফাইল ছবি

খোলা আকাশের নিচে অনুষ্ঠান করবার বড্ড ঝোঁক ছিল আমাদের। বসন্তোত্সব করব, তা ওই খোলা জায়গায়। শারদোত্সব, সে-ও খোলা জায়গায়। তবে বসন্তের জন্য সন্ধ্যারাত্রি, আর শরতের জন্য ভোরসকাল। পয়লা বৈশাখে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৩৭০ সনে, সকালবেলায়।

সে অনুষ্ঠানে বিদ্যায়তন উদ্বোধনের ব্যাপার ছিল বলে অনুষ্ঠান হয়েছিল তখনকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুল, পরের দিককার উদয়ন স্কুলের একতলার আধপাকা হল কামরায়। কিন্তু পরের বছর অনুষ্ঠান হলো প্রাঙ্গণের কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে। সকালে নয় অবশ্য, সন্ধ্যাবেলা। কয়েকটা বছর এমনই চলল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী—সব অনুষ্ঠানই স্কুলের মাঠে করা হতো।

টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার স্তবকসজ্জিত শাখা-প্রশাখার নিচে তৈরি মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে ভালোই লাগত আমাদের। কিন্তু পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা নিয়ে ক্রমে দর্শকদের ভেতরে অসন্তোষ লক্ষ করা গেল। তাঁদের বক্তব্য, স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সে ভালো কথা। কিন্তু আমরা তো সেই জন্য আসি না। আসি নববর্ষের বাণী অন্তরে বয়ে নিয়ে যেতে।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণে সন্‌জীদা খাতুনসহ অন্যরা
ছবি: সংগৃহীত

ঠিকই তো। এর কী করা? প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রছাত্রীদের একটি–দুটি রাগভিত্তিক সমবেত সংগীতে নতুন দিন কিংবা বৈশাখের কথাও থাকত। তবু এ তো বর্ষবরণের অনুষ্ঠান নয়। আর ওই সরু লম্বামতো জায়গাটুকুতে বর্ষবরণের মতন বড় ব্যাপার করা যায় কী করে।

বন্ধু নওয়াজেশ আহমদ তখন সম্ভ্রান্ত পাড়ার এক সুসজ্জিত সুন্দর বাড়িতে বাস করতেন। বছরে কোনো কোনো দিন এই বিত্তশালী সুজন খাওয়াদাওয়া আর গানের জন্য নিমন্ত্রণ করতেন ঢাকার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে। শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাঙালি রীতিতে বাড়িটিকে চমত্কার সাজিয়ে সকলের মুগ্ধ প্রশংসা আদায় করতেন। একবার সেই আয়োজন বাড়িতে না করে রমনা রেস্তোরাঁতে করবেন বলে জানালেন।

ভেতরের দিকটায় লেকের পানির ওপর কাঠের তৈরি এক্সটেনশন। পরে কতবার সেখানটায় বসে লেকের ওপরে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি দেখে বিস্ময়স্তব্ধ হয়ে গেছি। নওয়াজেশ কিছুদিন ধরেই পয়লা বৈশাখের উপযুক্ত প্রাঙ্গণের খবরাখবর করা শুনছিলেন। তাই সেদিন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন জায়গা দেখাতে। অন্ধকারের ভেতরেই টর্চের আলোতে বড় বড় ঘাস পেরিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে দক্ষিণ ঘেঁষে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলাম। পা কুটকুট করছে, ঘাসে একটা ভিজে ভিজে ভাবও রয়েছে। তাতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আরও বিপদ, এখানে–ওখানে গোবরও আছে। পচা গোবর মাড়িয়ে ফেললেই হয়েছে, কুটকুটানি আর দেখতে হবে না।

একটা বড় গাছের কাছাকাছি পৌঁছানো গেল। শুনলাম, অশ্বত্থগাছ। জায়গাটা বেশ বড়। সেদিনকার মতন ফিরে এলাম, দিনের আলোতেও দেখাটেখা হলো। ১৯৬৭ সালের কথা। ‘ছায়ানট’ তখন নিতান্ত ছোটখাটো এবং হতদরিদ্র প্রতিষ্ঠান। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা যারা করতে চায়, পাকিস্তান সরকার তাদের বন্ধু নয়। ছায়ানট থেকে ‘শ্রোতার আসর’ আয়োজন করে বাঙালির গান শোনানো হয় বাঙালিকে। বিস্মৃতস্মৃতি উদ্ধারের মতো ব্যাপার। ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন কোনোমতে চলে ছাত্র বেতন (শিশুদের ৩ টাকা, বড়দের ৫ টাকা), আর ছায়ানটের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সামান্য চাঁদায়। বড় অনুষ্ঠানের জন্য অনেক কিছু দরকার। নিমন্ত্রণপত্র চাই, মঞ্চসজ্জা চাই, মাইক্রোফোন তো লাগেই। তা আর্ট কলেজের ছেলেরা চলে এল হাতে হাতে কার্ড লিখে দিতে। কিন্তু কার্ডে তো অনুষ্ঠানের জায়গাটিকে অশ্বত্থতলা লিখতে মন চায় না। শোনায় যেন গ্রামের মেলা মেলা। ইচ্ছে হয় লিখি ‘বটমূল’। জবরদস্তিই বটমূল নাম চালু করে দেওয়া গেল শেষমেশ।

অনেক পরে ডিকশনারি ঘেঁটে একটা ব্যাখ্যা বার করেই ফেলি। দেখি, পঞ্চবটের সমাহার যে পঞ্চবটীতে, তার গাছগুলোর মধ্যে আছে অশ্বত্থ, বট, বিল্ব, আমলকী, অশোক। এই পাঁচ রকমের গাছ নিয়েই যদি পঞ্চবটী, তাহলে অশ্বত্থ তো পঞ্চবটের অন্যতমই হলো। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ‘বট’ শব্দের বিশ্লেষণ দিয়েছেন ‘বট্ (বেষ্টন করা)+অ (র্ত্তৃ), যে অধিক ভূভাগ আচ্ছাদন করে’। ডালপালা আর পাতা ছড়ানোর বড় গাছই তাহলে ‘বট’ নয়? তবে? আমাদের ‘বটমূলে’ গিয়ে এখনো অনেকে আক্রমণ করে প্রশ্ন তোলে—এখানে বটগাছ কই? বলুক গে যা-খুশি! আমরা তো ‘বটমূল’ বলতে পেরে খুশি আছি! আর নামকরণের যুক্তিই–বা কি কম বার করেছি খুঁজে?

যা–ই হোক, আমন্ত্রণপত্র তৈরিতে চারুকলার ছাত্ররা সেসব সময়ে আনন্দের সঙ্গে রাতভর কাজ করেছে। একবার তো সুসজ্জার জন্য বড় মাটির হাঁড়িতে বটপাতা ভিজিয়ে পচিয়ে নিয়ে ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে পাতার শিরা বার করা স্বচ্ছ রূপ এঁটে দিল চিঠিতে। মঞ্চসজ্জার কাজেও ওই ওরাই। তাই বলি, ছায়ানট কি একা একা বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখবার আর চর্চা করবার সংগ্রাম করেছে। সবাই ছিল যে পাশে।

মাইক্রোফোনের খবরটা বাঁচাবার পথ ছিল না। তবু সে আমলের কলরেডি আর ওদের ‘গোপালে’র কথা ভুলব না কখনো, কত কম খরচে যে ওরা আমাদের অনুষ্ঠান চালিয়ে দিয়েছে। আর সে কী আন্তরিকতা! তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কলকাতায় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সব অনুষ্ঠানে ‘গোপাল’দের পাশে পেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেছি।

সেই সাতষট্টি সাল থেকেই রমনার বটমূলে সমাবেশ। প্রথম দিকটা মঞ্চ তৈরি করার পাট ছিল না। গাছের গোড়াতে বাঁধানো জায়গাটুকুতেই গানের দল বসে যেত। কতজনই–বা থাকত তখন দলে। বিদ্যায়তনের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেলিনা, ইফফাত, আহসান মুর্শেদ, ফখরুল আবেদীন খান, রুমা মতীন, মাহজাবীন আর তার দুই বোন অদু, বাবলি—যাদের ভালো নাম এখন মনে নেই, আর কারা? ছোটদের মধ্যে ছিল তামান্না, তালাপ্পু, ছোটমণি...আর মনে পড়ে না। তারও পরে এল বেণু, শাহীন, ইকবাল, সাকী, ফ্লোরা, মঞ্জুর, সাদিয়া, ডালিয়া, স্বপন, মীনাক্ষী, ফওজিয়া আরও পরে রাণু, শাম্মী...অত নামের সব কি আর আজকে মনে করে লিখতে পারি? কোরাস গান ছাড়া একক গানও গাইত কয়েকজন।

ফাহ্‌মিদা, মাহ্‌মুদা, আখতার জাহান, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, মালেকা আজিম খান, ফরিদা বারি মালিক কতজনেই গান গেয়েছেন এসে। আফসারী খানমও গেয়েছেন স্বাধীনতাসংগ্রামের আগের বছর দুয়েক, মনে পড়ে। কলিম শরাফীও এসেছেন। আবৃত্তি করে সকলকে আপ্লুত করতেন গোলাম মুস্তাফা আর হাসান ইমাম। ইফফাতকে দিয়েও আবৃত্তি করানো হয়েছে মনে পড়ে যেন।

তারপর বাঁধানো বেদিতে বসে গান গাওয়ার কাল ফুরাল। শিল্পীরা অত নিচুতে বসলে দর্শকসারির দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায় না তাঁদের। মঞ্চ বেঁধে অনুষ্ঠান সাজানো শুরু হলো তখন থেকে। থই থই লোকে ভেসে যেত বটমূল থেকে রমনা রেস্তোরাঁ পর্যন্ত। সবশেষে রমনা রেস্তোরাঁতে তৈরি লুচি–তরকারি খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। পরে বাইরের দোকানে বায়না দিয়ে লুচি–তরকারি করিয়ে এনে খাওয়া চালু হয়েছিল। কিন্তু এ দেশের বাঙালি স্বাধীন হবার পরেই দড় হয়ে উঠল ব্যবসাবুদ্ধিতে! পয়লা বৈশাখের মাঠে যেখানে–সেখানে গজিয়ে উঠতে লাগল দোকান।

খাবারের দোকান তো ভালো কথা, দোকান কিনা পান্তাভাতের! শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। নাকি সানকিতে করে সে পান্তা কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে সুবেশধারী মানুষজন। বিপ্লবের কতই রকম। গ্রামদেশের দুঃখী মানুষের নিত্য–আহার এক দিন চেখে দেখে এ আবার কোন বাঙালিয়ানা। সমালোচনা শুরু হতো ছায়ানটেরই। তারাই নাকি গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বিদ্রূপ করে এই পান্তা খাওয়ার চল করেছে।

আমার সন্দেহ, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে দর্শকদের পেছন দিক থেকে উলু দিয়ে যারা ‘সমস্ত সবই হিন্দুয়ানির চর্চা’ বলে বোঝাতে চাইত, তারাই এই সব উদ্ভট কাজ দিয়ে সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছে। আর পয়সার নেশা তো শিক্ষিত যুবকসমাজে বিষ হয়ে ছড়িয়ে গেছে, দেখতে পাই সর্বত্র।

তাই মীনাবাজারের মোড়ে দোকান সাজানো কয়েক বছরের মধ্যেই হু হু করে বেড়ে ওঠে ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থলটিকে দূষিত করে ফেলল। কোথায় নতুন বছরের প্রীতিসম্মিলন, কোথায় নবজীবনের সত্য গ্রহণ, কোথায়বা মনের গভীরে শান্তি–সুষমার স্পর্শ নেওয়া! যেমন করে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে, সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের আনন্দকে দিনে দিনে নস্যাৎ করে দেবার চক্রান্ত হয়েছে, তারই পায়ে–পায়ে। পয়লা বৈশাখের এই বাঙালি অনুষ্ঠানটিও চলেছিল ধ্বংস হতে। আশ্চর্য এই, কিছুই না বুঝে এই অপকীর্তির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। খতিয়ে দেখেনি তাদের এই হালকা ফুর্তি কী ভয়াবহ সর্বনাশের সূচনা করতে চলেছে। এ যে বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসবকে কলুষিত করবার ষড়যন্ত্রে অংশী হওয়া।

মঞ্চ থেকে দুঃখ জানিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবার ঘোষণা দিয়েও ফল হয়নি। তখন বুদ্ধিজীবীরা কাগজে লেখালেখি করেছেন। সভা করে বাঙালির এই প্রধান উৎসবটিকে কলুষমুক্ত করবার পথ ভেবেছেন। গত বছর সর্বজনের সহায়তায় রমনার এই অঙ্গনে দোকানপাট করা বন্ধ হয়েছে।

এই শুভবুদ্ধির যোগে পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকলে ভবিষ্যতের বাঙালিও এই সুন্দর অনুষ্ঠানটি থেকে প্রশান্তির অনুভবে হৃদয় পূর্ণ করে নিতে পারবে। জীবনে এর প্রয়োজন যে কী অপরিসীম, সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। নববর্ষের প্রীতিসম্মিলন নাগরিকজনের বিলাস নয়, ধীরভাবে বাঙালিসত্তাকে উপলব্ধি করে জীবনের পথে নতুন উদ্যমে পা বাড়াবার অঙ্গীকার গ্রহণের প্রস্থানভূমি।

১৩৭৪–এর বৈশাখ থেকে এ পর্যন্ত কালের ইতিহাস ভাবলে আনন্দ হয়, আমরা বাঙালিরা আমাদের সামূহিক আকাঙ্ক্ষার বশে এমন একটি উৎসব নির্বাহ করবার শক্তি লাভ করেছি, যা বাঙালির স্বাধিকার বোধকে সমুদ্যত রাখবার চিরসহায় হয়ে রইল।

সূত্র: ভোরের কাগজ, ১৪ এপ্রিল ১৯৯৬