দেশের শিক্ষাক্রম এমন করতে হবে, যেন অভিন্ন জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা হিন্দুধর্মের বই পড়লে এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা ইসলাম ধর্মের বই পড়লে দুটি ভিন্নধারা হয়ে যায়। এভাবে ভিন্নধারা, ভিন্নচিন্তা নিয়ে বড় হলে শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে একসঙ্গে হতে পারবে না।
‘প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক সেমিনারে শিক্ষকদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে। বৈষম্য নিরসনে প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ আজ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে শিক্ষকেরা বলেন, সব ধর্মেই মানবতা, সত্য ও ভ্রাতৃত্বের কথা আছে। ফলে আলাদা ধর্মবই না করে, সব ধর্মের এসব বিষয় নিয়ে একক বই করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা সাম্প্রদায়িক হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন তারা দেশকে ভালোবাসে এবং তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠে।
ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে না উল্লেখ করে এম এম আকাশ বলেন, হিন্দু শিক্ষার্থীরা হিন্দুধর্মের বই পড়বে, মুসলিম শিক্ষার্থীরা মুসলিম ধর্মের বই পড়বে—এ রকম করলে একটা অসুবিধা থেকেই যায়। দুটি ভিন্নধারা হয়ে যায়।
সব ধর্মের সত্য, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের কথাগুলো নিয়ে একটি বই করার প্রস্তাব দিয়ে এম এম আকাশ বলেন, সব ধর্মেই মানবতার কথা, সত্যের কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা আছে। সব মিলিয়ে একটি বই সব শিক্ষার্থীকে পড়ানো যেতে পারে। কেউ ধর্ম নিয়ে বেশি চর্চা করতে চাইলে সে মাদ্রাসার মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ে একটি সিলেবাস থাকবে। এতে ধর্মের ব্যাপারে মিশ্রব্যবস্থা গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীরা সাম্প্রদায়িক হবে না।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব শিক্ষকের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো গড়ে তোলা এবং আগামী বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এক শতাংশ বাড়ানোর দাবি জানান এম এম আকাশ।
শিক্ষা খাতের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা জড়িত। তাই শিক্ষাকে বিশেষ খাত হিসেবে চিহ্নিত করে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, একটি জাতি কেমন হবে, তা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে।
সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক পালিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করে তানজীমউদ্দিন বলেন, ন্যায়ের পথ ছেড়ে ক্ষমতাশালীদের তোষামোদ করায় এমন অবস্থার তৈরি হয়েছে।
শিক্ষক হিসেবে নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস কম উল্লেখ করে তানজীমউদ্দিন বলেন, এর ফলে সমাজের কাছে শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। এ জন্য যতটা না অন্যরা দায়ী, তার চেয়ে শিক্ষকেরাও কম দায়ী নন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার প্রথম কাজ হলো এমনভাবে মনন গড়া যে শিক্ষার্থীদের মনে এমন নীতিনৈতিকতার জন্ম নেয়, যেন তার মাধ্যমে কারও অকল্যাণ হবে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন বিভাজনের চিন্তা না ঢুকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে।
অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও চিন্তা নিয়ে বড় হচ্ছে ছেলেমেয়েরা। বড় হয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে হতে পারবে না কখনো। একসঙ্গে বসে তারা চা খাবে না। বলবে ও অমুক ধর্মের, ও তমুক ধর্মের। ওর গায়ের রং সাদা, ওর কালো।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে শিক্ষা কমিশন হওয়া উচিত ছিল, যা হয়নি বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম ভূষ্ণা। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মুখস্থের জন্য চাপ দেওয়া যাবে না। সহজে বোধগম্য হবে, এমনভাবে শেখাতে হবে। খেলার মাধ্যমে শেখাতে হবে। গানের মাধ্যমে শেখাতে হবে। সে জন্য খেলার মাঠ, গান ও পরিবেশের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে মত দেন তিনি।
ভারতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বঞ্চিত ছিলেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা বৈষম্য কিছুটা দূর করতে পেরেছেন বলে উল্লেখ করেন পশ্চিমবঙ্গের ফকিরচাঁদ কলেজের সংগীত বিভাগের প্রধান উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদা আক্তার মনে করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকার প্রয়োজন নেই, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই যথেষ্ট। সেসব কমিটিতে এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁরা নানা বাজে মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সভাপতি শাহিনুর আল–আমীন। এ সময় তিনি লিখিত বক্তব্যে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড এবং প্রধান শিক্ষকদের নবম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা। প্রাক্–প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর বাস্তবায়ন করা। এ জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ ও ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা। প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা সৃষ্টি করা। মিড ডে খাবার চালু করা। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রভৃতি।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবুল কাসেম। এ সময় আরও বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি অজিত পাল, প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সভাপতি তপন কুমার মণ্ডল প্রমুখ।