১৮ কোটি টাকার ‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ গেমিং প্ল্যাটফর্ম ২ বছরেই বন্ধ
প্ল্যাটফর্মটি তৈরিতে শুধু ওয়েবপোর্টালেই কমপক্ষে ছয় গুণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। শেখ হাসিনার জন্মদিনে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন করা হয়।
শিশু–কিশোরদের জন্য ‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ নামের গেমিং প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করা হয়েছিল ১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে। অথচ দুই বছরের মধ্যেই ইন্টারনেট থেকে উধাও হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মটি। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এ প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শুধু ওয়েবপোর্টালের জন্যই কমপক্ষে ছয় গুণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
ওয়েবপোর্টাল ও সেই সঙ্গে ১২টি ইন্টারঅ্যাকটিভ গেমিং অ্যাপ্লিকেশনের সমন্বয়ে প্ল্যাটফর্মটি তৈরিতে আলাদা দরপত্র আহ্বান করেছিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন করা হয়েছিল।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর মোবাইল গেমস অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন (২য় সংশোধন)’ প্রকল্পের আওতায় ‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ (১২টি গেম) শিরোনামে একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০২১ সালের ৩ মার্চ। ৪ মাসের মধ্যে একই বছরের ২৬ জুলাই ‘ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ একাডেমি (আইডিয়া)’ প্রকল্প থেকে প্ল্যাটফর্মটির জন্য ওয়েবপোর্টাল তৈরিতে আরেকটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। আবেদনকারীদের জন্য দুটি দরপত্রের বর্ণনা ছিল হুবহু একই।
ওই দরপত্রে অংশ নিয়ে দুটি কাজই পায় গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ১২টি গেমিং অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ও ওয়েবপোর্টাল তৈরিতে ৬ কোটি ৪৫ টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা বাবদ খরচ ছাড়া বাকি অর্থ প্রতিষ্ঠানটিকে পরিশোধ করা হয়েছে।
প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ কেন, জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর মোবাইল গেমস অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সম্ভবত (রাজনৈতিক) পরিস্থিতির কারণে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে তারা (গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেক)।’
প্ল্যাটফর্মটির গল্প ও গেমের বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর (ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা) জীবনাদর্শ, চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-কর্ম, আদর্শিক বিষয় যেমন মুক্তিযুদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি।
একই প্রশ্নের জবাবে আইডিয়া প্রকল্পের পরামর্শক মোমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন কেন বন্ধ, সেটা তো আপনিই বুঝতে পারছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো তাঁরা সাটডাউন করে দিয়েছেন।’
জানা গেছে, ২০১৯ সালে মৌখিকভাবে গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেককে ওই প্ল্যাটফর্মের কাজ করতে বলা হয়। বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজটি শুরুর দুই বছর পর দরপত্র আহ্বান করে কাজ দেওয়া হয় গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেককে। খরচ বেশি বলে ওয়েবপোর্টাল ও গেমিং অ্যাপ্লিকেশন খাতে ব্যয় ভাগ করে দুই প্রকল্প থেকে টাকার বন্দোবস্ত করা হয়। কাজটি সময়ে সময়ে দেখেছেন আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়
ওয়েবসাইট ডিজাইন ও গেম তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, প্ল্যাটফর্মটিকে উন্নত মানের বলা হলেও এর অর্ধেকের বেশি গল্প ও গেম চালু ছিল না। ৩২টি গল্প ও গেমের মধ্যে ১২টি চালু ছিল। আর যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা–ও যৌক্তিক নয়।
এই ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণ মানের ওয়েবপোর্টাল ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় তৈরি হয়। মাঝারি মানের হলে প্রাথমিক সেটআপে খরচ এক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। অতি উন্নত মানের হলে ২৭ শতাংশ কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ধরে ওয়েবপোর্টাল ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে হতে পারে।
এখন কেন বন্ধ, সেটা তো আপনিই বুঝতে পারছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো তাঁরা শাটডাউন (বন্ধ) করে দিয়েছেন।
ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে—এমন প্রতিষ্ঠান কাজটি করলে সে ক্ষেত্রে বেশি দাম ধরেও ওয়েবপোর্টালের খরচ ১ কোটি টাকার বেশি হতে পারে না। অর্থাৎ ‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’–এর শুধু ওয়েবপোর্টাল তৈরিতেই কমপক্ষে ৬ গুণ খরচ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মোমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি কমিটির মাধ্যমে ওয়েবপোর্টাল তৈরির জন্য কত টাকা খরচ হবে, সেটি ঠিক করা হয়েছিল। তাই যত ব্যয় হয়েছে, তা ঠিক ছিল কি না, সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। তিন বছরের ব্যবস্থাপনাসহ (২০২৫ সাল পর্যন্ত) খরচ ৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নামে ছিল, তাই এটি বেশ উন্নত মানের ও অনেক ফিচারসমৃদ্ধ ছিল। এটা সাধারণ ওয়েবপোর্টাল ছিল না। সাধারণ ওয়েবপোর্টাল অনেক কম টাকায় করা যায়।’
একই প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শেষ হলে তিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থ ধরা হয়েছিল, সেটা সম্পর্কে তাঁর জানা নেই।
দরপত্রে অংশ নিয়ে দুটি কাজই পায় গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেক। ১২টি গেমিং অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ও ওয়েবপোর্টাল তৈরিতে ৬ কোটি ৪৫ টাকা ব্যয় ধরা হয়।
এদিকে পুরো প্ল্যাটফর্ম বাবদ যে হিসাব দেখানো হয়েছে, সেটিও খুবই অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন সফটিমাইজ নামে একটি সফটওয়্যার সলিউশন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আসিফ উল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, উন্নত ওয়েবপোর্টাল ও ১২টি (৩২টি গল্প) গেমিং অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ইন্টারঅ্যাকটিভ প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে খুব বেশি হলেও ১ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি খরচ হতে পারে না।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আসিফ উল ইসলাম বলেন, শুধু ওয়েবসাইট তৈরিতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাগতে পারে। ব্র্যান্ড ভ্যালুসম্পন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান বানালেও শুধু ওয়েবসাইটের জন্য সেটআপ খরচ এক লাখ টাকার বেশি হয় না। প্রাথমিক ধাপের পর প্রতিটি অ্যাপ্লিকেশনের স্টোরিলাইন যদি ভিন্ন হয় (ধরা যাক, সেটি ৪–৫ মিনিটের গেম, ৬ ধাপ পর্যন্ত খেলা যায় ও ১০–১৫টি তথ্যসমৃদ্ধ), তাহলেও খুব বেশি ধরলে একেকটি স্টোরিলাইনের জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে ৩২টি গল্পের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা লাগতে পারে।
প্ল্যাটফর্মটি তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) কর্নেল মো. নাসিমুল আলম। গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।
অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নাসিমুল আলম প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গেমিং প্ল্যাটফর্মটি তৈরির জন্য ফরাসি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন নারী কিউরেটর এক বছর ধরে গবেষণা করেছেন। তিনি দুই–তিনবার বাংলাদেশে এসেছেন, থেকেছেন। ফ্রান্সে তিনি শিক্ষক, শিল্পী, মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে কমিটি গঠন করে যা যা প্রস্তাব করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করে প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করা হয়েছে। মাঝে ২০২০ সালে কোভিডের কারণে কাজ বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে গিয়েছিল। তবে বয়সভিত্তিক শিশুদের চরিত্র, পোশাক, রং, শব্দ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে যেভাবে কাজ করা হয়েছে তাতে খরচ বেশি হয়েছে বলা যায় না।
ওই কাজে গোল্ডেন হারভেস্ট আর্থিকভাবে লাভবান হয়নি দাবি করে নাসিমুল আলম বলেন, ‘পুরো অর্থও পায়নি। ভ্যাট-ট্যাক্স কাটার পর ১৩ কোটি টাকার মতো পেয়েছিল প্রতিষ্ঠান। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্ল্যাটফর্মটি এখন বন্ধ।’
কী ছিল প্ল্যাটফর্মে
তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুসারে, www.hasinaandfriends.gov.bd পারস্পরিক যোগাযোগের এ গেমিং প্ল্যাটফর্ম বাংলা ভাষায় প্রথম ছিল। এতে ইংরেজি ভাষাও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ৬ থেকে ১৬ বছরের শিশু–কিশোরদের ইন্টারঅ্যাকটিভ গল্প ও গেমের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানানো।
বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা) জীবনাদর্শ, চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন–কর্ম, আদর্শিক বিষয়াবলি যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি। প্ল্যাটফর্মে ১২টি গেম, ৩২টি গল্প ও কুইজ রাখা হয়।
৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ছিল মাছের রাজা ইলিশের অভিযান গেম, ফুড ম্যানিয়া, নিখুঁত ছবি ও কুইজ গেম (সংযোগ), ৯ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য সুন্দরবন অভিযান গেম, কুইজ গেম (স্বাস্থ্য), আশ্চর্য নারী, টেক স্যাভি এবং ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের জন্য কুইজ গেম (শিক্ষা), রিসাইকেল আপসাইকেল, কুইজ গেম (স্বাস্থ্য) এবং কানেক্ট সোয়াইপ।
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, ২ বছরে এ প্ল্যাটফর্মে ১ লাখ ৬৫ হাজার ব্যবহারকারী নিবন্ধন করেছিল। ওয়েবসাইটটি পরিদর্শন করেছিল ১০ লাখের মতো মানুষ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য ইন্টারঅ্যাকটিভ গেমিং প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সংযোগ নিয়ে দেশে যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছিল, তা তথ্য বা ধারণা প্রচারের জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এটি তৈরিতে রাষ্ট্রের অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। তাই প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ না করে, বরং যেখানে প্রয়োজন, সেখানে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা যেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেটি করা উচিত।
প্ল্যাটফর্মটিতে ব্যয় বেশি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক মইনুল বলেন, ‘একটি সিস্টেম মানে শুধু আপাতদৃষ্টে একটি ওয়েবপোর্টাল বা ওয়েবসাইট নয়; সেখানে একই সঙ্গে কত ব্যবহারকারী প্রবেশ করতে পারবে, নকশা, নিরাপত্তা, মান, ব্যাকআপ, পরবর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনার ওপর প্রকৃত ব্যয় নির্ভর করে। সেটি বিস্তারিত না দেখে ব্যয়ের ব্যাপারে ধারণা করা কঠিন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যয় বেশি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
যে প্রতিষ্ঠান কাজ নেবে, তারা বেশি দাম চাইতেই পারে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উচিত, দর–কষাকষি ও বাজার যাচাইপূর্বক প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে যথাযথ দাম নির্ধারণ করা বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক মইনুল।