রাজধানীর ধানমন্ডিতে থাকেন এ এম নাহিয়ান হোসেন। কিন্ত বাসায় বসেও তাঁর মুঠোফোনে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হয়। অথচ ওই এলাকায় সাতটি টাওয়ার রয়েছে অপারেটরটির। আবার দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা আমানুর রহমান অভিযোগ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা এলাকায় ভালো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ঢুকতে দেয় না, এমনকি বিটিসিএলের সেবাও পাওয়া যায় না।
আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কার্যালয়ে আয়োজিত বিটিআরসির পঞ্চম গণশুনানিতে গ্রাহকেরা এমন বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
গণশুনানিতে ধানমন্ডির ওই বাসিন্দা বলেন, নেটওয়ার্ক না পাওয়া নিয়ে এই সমস্যার কথা তিনি দুই বছর ধরে গ্রামীণফোনের কাছে বলে আসছেন। কিন্তু কোনো সমাধান পাননি। গ্রামীণফোন তাঁকে জানিয়েছে যে তাঁর এলাকায় একটি টাওয়ার বসাতে হবে, কিন্তু জায়গা দিতে কেউ রাজি হচ্ছেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিওওয়াই–ফাই প্রযুক্তি কেন বাংলাদেশে চালু করা হচ্ছে না, সেটাও জানতে চান তিনি।
বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মুস্তাফিজুর রহমান এই গ্রাহকের সমস্যার বিষয়ে বলেন, যেভাবে অবকাঠামো বাড়ছে, তাতে বহুতল ভবনে নেটওয়ার্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিটিআরসি প্রতিটি বহুতল ভবনের মধ্যে যেন সঠিক উপায়ে ডিজিটাল সংযোগ থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য বিল্ডিং কোডের মধ্যে একটি ধারা যুক্ত করা হবে।
কাজী মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ভিওওয়াইফাই প্রযুক্তির জন্য ইতিমধ্যে গ্রামীণফোন প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বিটিআরসি। এখানে সরকারের আইনগতভাবে নজরদারির বিষয় দেখা হচ্ছে। যাঁরা এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হবেন, তাঁদের চিহ্নিত করার দিক থেকে কারিগরি জটিলতা আছে। এটাতে যদি সমাধান আসে, তবে দ্রুতই এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে চালু হবে।
দেশের বাইরে রোমিং সেবা নিতে হলে ব্যক্তিগত ক্রেডিট কার্ডের ফটোকপি অপারেটরদের কাছে দিতে হয়। কেন এত নথি দিতে হয়, সেটাও জানতে চান এক গ্রাহক। এ বিষয়ে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, লেনদেনে নজরদারি করার জন্য এটা করা হয়। এই প্রক্রিয়া সহজ করতে বিটিআরসি যোগাযোগ করছে।
গণশুনানির শুরুতে সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান একটি উপস্থাপনা প্রদর্শন করেন। সেখানে তিনি জানান, এবার গণশুনানিতে ৩ হাজার ২০৫টি প্রশ্ন এসেছে। ২৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। দেশের টেলিযোগাযোগ সেবার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা ছাড়া তিনি জানান, ডেটা প্যাকেজ নিয়ে একটি জরিপ করা হচ্ছে। সেখানে ৬৫ হাজারের বেশি প্রশ্ন এসেছে।
খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা মুন্সি আমানুর রহমানের অভিযোগ, এলাকায় ভালো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ঢুকতে দেন না স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ অভিযোগের পর শুনানিতে উপস্থিত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বিটিসিএলের খিলগাঁও কার্যালয়ে যোগাযোগ করে সাত দিনের মধ্যে উচ্চগতির ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। ইন্টারনেট সেবাদাতা অ্যাসোসিয়েশনকেও বিষয়টি দেখার আহ্বান জানান তিনি।
গ্রাহকদের যত অভিযোগ
শুনানিতে কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ ছিল, রির্চাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অব্যবহৃত টাকা অপারেটর নিয়ে নিচ্ছে। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যালেন্সের রিচার্জের মেয়াদ গ্রামীণফোন ৩৫ দিন করেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা শেষ না হলে তা অপারেটর নিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহককে অপারেটর ক্ষতিপূরণ দেবে কি না, জানতে চান তিনি।
এর জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল বলেন, আগামী সপ্তাহে ব্যালেন্স রিচার্জ নিয়ে অপারেটরদের সঙ্গে বসবে বিটিআরসি। সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা প্রণয়নের বিষয় আসবে। কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে অব্যবহৃত টাকা কর্তন এবং টাকা যেন ফেরত আসে, এসব দিকে খেয়াল রাখা হবে।
খুলনা থেকে অনলাইনে গণশুনানিতে যুক্ত হয়ে আজমিরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক বলেন, এজেন্টদের কাছ থেকে সিম কিনতে গেলে অনেকে চালাকি করে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর বলেন, সিম নিবন্ধন করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই ছাপ ব্যবহার করে অন্যদের কাছে এজেন্টরা সিম বিক্রি করছেন। এতে নিরাপত্তাহীনতা ও হেনস্তার শিকারের আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
এই অভিযোগের বিষয়ে খলিল-উর-রহমান বলেন, বিষয়টি তাঁদের নজরে এসেছে। বিটিআরসি নিয়ম করেছে, কারও যদি একবার আঙুলের ছাপ এসে যায়, তাহলে পরবর্তী তিন ঘণ্টার মধ্যে অন্য কোনো ছাপ নেওয়া যাবে না। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিটিআরসিকে জানাতে অনুরোধ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ আমির হোসেন জানান, বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স নিতে দুবার ঢাকায় আসতে হয় তাঁদের। এটা সহজ করার অনুরোধ জানান তিনি।
গণশুনানিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, গ্রাহকদের টাকা যেন তাঁদের অজান্তে এবং অব্যবহৃত টাকা কেটে নেওয়া না হয়। বিদেশে গেলে রোমিংয়ের জন্য ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ভেরিফাই করতে হচ্ছে, এটা জেনে তিনি বিব্রত। এ বিষয়ে একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, একজন নাগরিককে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য একটা সিস্টেমে একবারের বেশি যেন দিতে না হয়।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, প্রতিবছরই এই গণশুনানি হবে। এরপরের শুনানি হবে রাজশাহীতে। গণশুনানিতে স্বাগত বক্তব্য দেন বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক। আরও উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসির অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের কমিশনার মুশফিক মান্নান চৌধুরী, সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের কমিশনার মো. দেলোয়ার হোসাইন, প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন, লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু, মুঠোফোন অপারেটরদের প্রতিনিধিসহ বিটিআরসির বিভিন্ন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।