বিচার শুরু হওয়ার পর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

  • আরও সংস্কার কমিশন হবে।

  • ইসি পুনর্গঠন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ হবে।

  • শেখ হাসিনাকে ফেরাতে চাইবে সরকার।

  • যারা গণহত্যা করেছে তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে না।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলছবি: প্রথম আলো

সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত ছয়টি কমিশন অক্টোবরের মধ্যে কাজ শুরু করবে। কাজ শেষে তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা করছে সরকার। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার বিষয়ে আলোচনা শুরু করবেন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধানদের এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সংস্কার বিষয়ে সরকার পরামর্শমূলক মতবিনিময় সভা করবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব সভায় সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। এ সময় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমও বক্তব্য রাখেন।

এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর মধ্যে বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে, সফর রাজ হোসেন পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনে, সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনে, ইফতেখারুজ্জামান  দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনে, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে থাকবেন। এ দিন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে গত বুধবার শাহদীন মালিকের পরিবর্তে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এই বৈঠকে অধ্যাপক আলী রীয়াজ অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। বাকিরা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন। সভায় সংস্কার কমিশনের কার্যপরিধি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

আরও সংস্কার কমিশন হবে

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেগুলো অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। যাতে সবার মতামতের প্রতিফলনের সুযোগ থাকবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি ছিল একটি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এ ছাড়া বাংলাদেশে যেন আর কোনো দিন ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা ফিরে না আসে, সে জন্য কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন তা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিল। সেটার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ছয়টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে।

এ পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল। নির্বাচনের অনুষ্ঠানের আগে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। সেটি হলো বাংলাদেশের যে প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৫ বছরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং ৫৩ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারছে না, সেগুলো ঢেলে সাজানো। প্রাথমিকভাবে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এরপর আরও সংস্কার কমিশনের চিন্তা তাঁদের মধ্যে আছে। কমিশনগুলো স্বাধীন থাকবে।

এ সময় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ছিলাম। আমরা ভোটাধিকার থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছি। অতীতটা যেন আবার পুনরাবৃত্তি না হয়। এ জন্য নানা বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে, সংস্কার করতে হবে।’

ইসি পুনর্গঠন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ হবে

সংস্কারে কত সময় লাগবে-এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আরও যেসব সংস্কার কমিশন হবে সেগুলো এই সংস্কার কমিশনের (ইতিমধ্যে হওয়া ছয় কমিশন) ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবে না। কিছু সংস্কার থাকবে যা তাৎক্ষণিকভাবে করা যাবে, কিছু সংস্কার থাকবে মধ্য মেয়াদি, কিছু দীর্ঘ মেয়াদি। আর কিছু সংস্কার প্রস্তাব থাকবে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের জন্য।

আইন উপদেষ্টা বলেন, আলোচনা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ফিরে আসার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের চিন্তা করা হবে। তারপর একপর্যায়ে ভোটার তালিকা হালানাগাদের চিন্তা করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আপনারা বুঝতে পারবেন, আমরা শুধু সংস্কার ভাবনায় নিজেদের আবদ্ধ রাখব না। তার সঙ্গে সুস্থ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা যাতে ফিরে না আসে তা বিলোপ করার জন্য বাস্তব যে কাজ আছে সেগুলোও পাশাপাশি করতে থাকব।’

শেখ হাসিনাকে ফেরাতে চাইবে সরকার

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতে যদি কোনো দণ্ডিত বাংলাদেশি থাকেন, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা যে কেউ হোন না কেন তাঁর প্রত্যর্পণ চাইতে পারে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার বিপ্লবকালে যে গণহত্যা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, তার বিচারের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। অচিরেই বিচার শুরু হবে। বিচার শুরু হওয়ার পর অবশ্যই প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে।

যারা গণহত্যা করেছে তাদের সঙ্গে আলোচনা নয়

সংবিধান সংস্কার কীভাবে হবে সে বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, কমিশন সব সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে দেখবে। কী হবে সেই সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না, এই সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্যই এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। যতভাবে পারা যায় সমাজের সব অংশের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করা হবে। তবে যারা গণহত্যাকারী, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। তাদের বাদে সমাজের যত প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণি আছে, রাজনৈতিক দল, সামাজিক, পেশাজীবী, ছাত্র সংগঠন এবং যারা গণ-অভ্যুত্থানে ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে যতভাবে পারা যায় তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো হবে। কমিশনই এটি করবে।

আইন উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে সহযাত্রী করার জন্য পরামর্শ সভা করা হবে। এ ক্ষেত্রে আগে বিভিন্ন সময়ে করা সংস্কারের প্রতিবেদনও বিবেচনায় নেওয়া হবে।