কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার খুটাখালীর পাহাড়ি গ্রাম সেগুনবাগিচা। সেখানে বনের জায়গায় টিন ও কাঠের বেড়ায় তৈরি ছোট্ট ঘরে দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে থাকেন মুরশিদা বেগম (৩২)। এত দিন বাড়ির পাশের বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন সেই কষ্ট করতে হয় না তাঁকে। আট মাস আগে বাড়ির পাশে ফরেস্ট অফিস এলাকায় মুদিদোকান দিয়েছেন তিনি। সেখানে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বিক্রি হয় চা-বিস্কুটও। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে তাঁর দোকান।
মুরশিদার মতো খুটাখালী এলাকার কয়েক শ নারী একসময় বনাঞ্চল থেকে কাঠ কুড়াতেন। সে পেশা ছেড়ে তাঁরা এখন খামারি ও উদ্যোক্তা হয়েছেন। অনেকে ঘরে হাঁস, মুরগি, কবুতর, গরু ও ছাগল পালছেন। আবার কেউ সেলাই করে এবং কেউ শাকশবজি চাষ করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
বন বাঁচাতে বিকল্প পেশা বেছে নিতে এসব নারীকে ঋণ দিচ্ছে সরকার। এ জন্য সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন অধিদপ্তর সুফল নামের একটি প্রকল্প (টেকসই বন ও জীবিকা) হাতে নিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেচার কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও সদর উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কক্সবাজারের চার উপজেলায় ৩ হাজার ৬৭৩ দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার নারী।
৪ মার্চ দুপুরে মুরশিদা বেগমের দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত তিনি। চা তৈরির পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নানা পণ্য এগিয়ে দিচ্ছিলেন। পেঁয়াজ, লবণ, তেল, আলুসহ দোকানে ২০ হাজার টাকার মতো পণ্য আছে বলে জানালেন মুরশিদা।
মুরশিদা বেগম বলেন, দিনে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়। তাতে লাভ থাকে ২০০-৩০০ টাকা। দোকানের পাশাপাশি মুরশিদা ঘরে ছোট খামারও করেছেন। সেখানে ৩৩টি মুরগি, ৫টি ছাগল ও ৩৫ হাজার টাকায় কেনা একটি গাভি রয়েছে। খামার ও দোকান করার জন্য তিনি সুফল প্রকল্প থেকে পেয়েছেন ৪২ হাজার টাকার ঋণ। মাসে মাসে ঋণের কিস্তি শোধ করেও কিছু টাকা জমা থাকছে তাঁর।
মুরশিদার খানিকটা দূরে চায়ের দোকান করছেন শারমীন আক্তার (৩৫)। তিনিও ঋণের টাকায় দোকানটি খুলেছেন। দৈনিক বেচাবিক্রি হয় ৩ হাজার টাকার মতো। শারমীন বলেন, আগে গ্রামে তেমন দোকানপাট ছিল না, লোকজন কয়েক কিলোমিটার দূরের হাটবাজার থেকে মালামাল কিনে আনত। এখন বাড়ির কাছে অনেক দোকান হয়েছে এবং বেশির ভাগ দোকান নারীদের। লাভজনক হওয়ায় গ্রামের অনেক নারী ক্ষুদ্র ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছেন।
জীবনমানের উন্নতি
পিজিমা মারমার (২৩) বাড়ি রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের দুর্গম লৌহাঝিরি পাড়ায়। পড়ছেন কক্সবাজার সিটি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি সেলাই ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
কয়েক মাস আগে বাড়িতে সেলাই মেশিন কিনে স্থানীয় মেয়েদের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। চলে কাপড়চোপড় সেলাই। তাতে লাভবান হচ্ছেন দরিদ্র ঘরের মেয়েরা। পিজিমা মারমা প্রথম আলোকে বলেন, সুফল প্রকল্পের ২৫ হাজার টাকার ঋণ থেকে সেলাই মেশিন কেনা হয়। অবশিষ্ট টাকায় বাড়ির পাশের কয়েক কানি জমিতে ধান চাষ হচ্ছে। তাতে সংসারের অভাব দূর হচ্ছে।
২৫ হাজার টাকার ঋণসহায়তা নিয়ে বাড়িতে হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন ঈদগড় ইউনিয়নের বৈদ্যপাড়ার থায়েন গ্রু (৩৪)। স্বামী বেকার। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন অনেক।
থায়েন গ্রু বলেন, খামারের হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে চলছে তাঁর সংসার। হাটবাজারে ডিম ও মাংসের চাহিদা অনেক। খামারটি বড় করার চেষ্টা চলছে।
রামুর ঈদগড়ের ইউপি সদস্য শাহীন আক্তার বলেন, আগে যাঁরা বনের গাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সুফল প্রকল্পের সহায়তায় তাঁরা এখন হাঁস-মুরগি, শাকসবজি, ধান চাষ, মুদিদোকান, রেস্তোরাঁ ও কাপড় সেলাই করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাতে রক্ষা পাচ্ছে বনাঞ্চলের গাছপালা ও বন্য প্রাণী।