অনেক দাবি আর অভিযোগের মধ্যে চলছে বইমেলার প্রস্তুতি

অমর একুশে বইমেলার জন্য স্টল তৈরির কাজ চলছে। এবারও মেলা হবে বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। উদ্যানের মাঠে কাজে ব্যস্ত একজন কর্মী। ঢাকা, ৯ জানুয়ারিছবি: দীপু মালাকার

অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ শুরু হতে তিন সপ্তাহ বাকি। বিগত এক দশকের মতো এবারও মেলার আয়োজন হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। শুরু হয়েছে স্টল তৈরির প্রাথমিক কাজ। তবে এর মধ্যে সৃজনশীল প্রকাশকদের তিন সংগঠনের প্রতীকী অনশন, প্যাভিলিয়নের ধরনে পরিবর্তন এবং ১৮টি প্রকাশনা সংস্থাকে কালোতালিকাভুক্ত করার মতো দাবি নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা–সমালোচনা। এ নিয়ে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এখন বিভক্ত।

বাংলা একাডেমি এরই মধ্যে এবারের একুশে বইমেলার প্যাভিলিয়নের ধরনে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের পর বাংলা একাডেমি বইমেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত আগামীকাল শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছে বইমেলা পরিচালনা কমিটি।

এবার মেলা শুরুর আগেই সবচেয়ে বেশি আলোচনা–সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ১৮টি প্রকাশনা সংস্থার একটি তালিকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে তালিকা প্রকাশ করে একদল প্রকাশক দাবি করেছেন, ওই প্রকাশনা সংস্থাগুলো বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। সেগুলোকে কালোতালিকাভুক্ত করতে হবে।

তবে সেই তালিকায় থাকা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ অভিযোগ অমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পরিবর্তিত সময়ে যাঁরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছেন, তাঁরাই নানা রকম দাবি তুলছেন। এতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে অমর একুশে বইমেলা।

চিহ্নিত ১৮ প্রকাশনা সংস্থা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একটি তালিকা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১৮টি প্রকাশনীর নামের পাশে ক্রসচিহ্ন দেওয়া। এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো হচ্ছে অনিন্দ্য প্রকাশ, অনুপম প্রকাশনী, অন্বেষা প্রকাশন, অন্যপ্রকাশ, আগামী প্রকাশনী, কাকলী প্রকাশনী, জার্নিম্যান বুকস, তাম্রলিপি, পাঠক সমাবেশ, পুঁথি নিলয়, মিজান পাবলিশার্স, সময় প্রকাশন, চারুলিপি প্রকাশন, জিনিয়াস পাবলিকেশনস, নালন্দা, পার্ল পাবলিকেশন্স, বিশ্বসাহিত্য ভবন এবং শব্দশৈলী।

মেলায় এই প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে প্যাভিলিয়নের বদলে সাধারণ স্টল বরাদ্দ দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. গফুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাদের প্যাভিলিয়ন না দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাব বিস্তার করে যারা বইবাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি করেছে, আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি। তাদের কালোতালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। সিদ্ধান্ত এখন বাংলা একাডেমির মেলা পরিচালনা কমিটির।’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার স্টল তৈরির কাজ করছেন একজন কর্মী। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি
ছবি: দীপু মালাকার

এদিকে জার্নিম্যান বুকসকে মেলায় নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে বলেও জানা গেছে।

কোন প্রক্রিয়ায় এই তালিকা নির্ধারণ করা হলো, তা জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং জাতীয়তাবাদী প্রকাশক সমিতি—এই তিন সংগঠনের সদস্যরা ৭ জানুয়ারি একসঙ্গে বসে এই তালিকা তৈরি করেছেন।

আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাব বিস্তার করে যারা বইবাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি করেছে, আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি। তাদের কালোতালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। সিদ্ধান্ত এখন বাংলা একাডেমির মেলা পরিচালনা কমিটির
মো. গফুর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

তালিকাভুক্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্য থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন প্রকাশক প্রথম আলোকে বলেছেন, যাঁরা কালোতালিকার দাবি জানাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার নিয়ে তাঁরাও বই প্রকাশ করেছেন। তাঁরাও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বহু বইও প্রকাশ করেছেন। এখন রাতারাতি তাঁরাই ফ্যাসিবাদবিরোধী নেতা সাজতে চাইছেন।

তালিকাভুক্ত প্রকাশনা সংস্থা সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ৭০ থেকে ৮০টি প্রকাশনীর বই থাকে। অথচ তাঁরা বেছে বেছে ১৮টি প্রকাশনা সংস্থার তালিকা করেছেন। যাঁরা দাবি উত্থাপন করছেন, তাঁদের বইও এসইডিপি প্রকল্প, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বা গণগ্রন্থাগারের বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই বিভাজনের ভিত্তি তাহলে কী? তিনি বলেন, সরকার যেখানে প্রকাশকদের দুর্নীতি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেনি, সেখানে একতরফা অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু করা হলে সেটা হবে ক্ষতিকর ও দুর্ভাগ্যজনক।

সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ৭০ থেকে ৮০টি প্রকাশনীর বই থাকে। অথচ তাঁরা বেছে বেছে ১৮টি প্রকাশনা সংস্থার তালিকা করেছেন। যাঁরা দাবি উত্থাপন করছেন, তাঁদের বইও এসইডিপি প্রকল্প, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বা গণগ্রন্থাগারের বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই বিভাজনের ভিত্তি তাহলে কী?
ফরিদ আহমেদ, স্বত্বাধিকারী, সময় প্রকাশন

তালিকাভুক্ত আরেক প্রকাশক বলছেন, বৈষম্যবিরোধী প্রকাশনীর নেতৃত্বে থাকা সূচিপত্র, আবিষ্কার, রিদম প্রকাশনা থেকেই বিগত সরকারের আমলে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। রিদম প্রকাশনা থেকে ‘বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও মৎস্য খাতে উন্নয়ন প্রতিভাস’, ‘সত্তায় স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আজকের বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছে। সূচীপত্র থেকে ‘যুদ্ধাপরাধ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’, ‘একাত্তর ও আমার যুদ্ধ’ ও  ‘কোর্ট মার্শাল: আমি মৃত্যুকে পরোয়া করি না’ শিরোনামের বই প্রকাশিত হয়েছে। আবিষ্কার প্রকাশনীর বই আছে ‘জাতির পিতা ও চার নেতা’, ‘একাত্তরের পরাশক্তির যুদ্ধ’, ‘বঙ্গমাতা: কুসুমিত ইস্পাত’–এর মতো শিরোনামে। এসব বইয়ের লেখকদের মধ্যে আছেন বিগত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং দলীয় ব্যক্তিরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে এসব প্রকাশকের অনেকের ছবিও আছে।

বইমেলার প্যাভিলিয়ন–স্টল তৈরির জন্য ট্রাকযোগে বাঁশ আনা হয়েছে। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি
ছবি: দীপু মালাকার

বৈষম্যবিরোধী প্রকাশক সমিতি, বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী প্রকাশক সমিতি এক সপ্তাহ আগে বাংলা একাডেমির কাছে ১৪ দফা দাবি জানিয়েছে। এসব দাবির মধ্যে আছে ৫০ শতাংশ স্টল ভাড়া কমানো, সব স্টল একই ধরন করে তৈরি, প্রবেশমূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি। তাঁরা দাবি আদায়ের জন্য বাংলা একাডেমিতে প্রতীকী অনশনেও বসেন। এসবের মধ্যেই বাংলা একাডেমির মেলা পরিচালনা কমিটি মেলার প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে।

প্যাভিলিয়নে পরিবর্তন

এবারের মেলায় প্যাভিলিয়নের ধরন বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি। নতুন ধরন অনুযায়ী মেলায় প্যাভিলিয়ন দর্শনার্থীদের প্রবেশ ও বহির্গমন ব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব সরকার আমিন বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেলা পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তে প্যাভিলিয়নের ধরনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কারা প্যাভিলিয়ন পাবে কিংবা কারা মেলায় অংশ নিতে পারবে না, এসবের দাবি আছে। তবে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।’

তালিকাভুক্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্য থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন প্রকাশক প্রথম আলোকে বলেছেন, যাঁরা কালোতালিকার দাবি জানাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার নিয়ে তাঁরাও বই প্রকাশ করেছেন। তাঁরাও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বহু বইও প্রকাশ করেছেন। এখন রাতারাতি তাঁরাই ফ্যাসিবাদবিরোধী নেতা সাজতে চাইছেন।

প্যাভিলিয়নের আয়তন আগের মতো থাকলে এর ধরনও যাতে আগের মতোই থাকে, বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমির কাছে সে আবেদন করেছেন প্যাভিলিয়নের জন্য আবেদন করা প্রকাশকেরা। নইলে প্যাভিলিয়নে আসা পাঠকেরা ভালোভাবে সব বই দেখার সুযোগ পাবেন না বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তালিকায় থাকা ১৮ প্রকাশনীর একজন প্রকাশক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এমন আটকানো নকশায় প্যাভিলিয়ন বানিয়ে মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের পথ রাখলে পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হবে, এতে অল্প পরিসরের প্যাভিলিয়নে বই বিক্রিতে বাধা হবে। এটা আটকানো দম বন্ধ করা একটা নকশা। এভাবে পাঠককে ঠকানো হয়। সে যে বইটি খুঁজছে, সে পর্যন্ত হয়তো দেখতেই পারবে না প্রদর্শিত বইয়ের মধ্য থেকে।

গত বুধবার ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ পরিচালনা কমিটি’র এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় আজ বৃহস্পতিবারও কমিটি আবার আলোচনায় বসে।

প্রাথমিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে মোট ৫৯৩টি প্রতিষ্ঠান। প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পাচ্ছে ২৮ থেকে ২৯টি প্রকাশনা সংস্থা। অতীতে প্যাভিলিয়ন পাওয়া অনিন্দ্য, অন্বেষা প্রকাশন, তাম৶লিপি, পাঠক সমাবেশসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থাকে দেওয়া হচ্ছে ৩ থেকে ৪ ইউনিট করে স্টলের বরাদ্দ। প্যাভিলিয়ন পেলেও আয়তনে কমতে পারে আগামী ও অন্যপ্রকাশের বরাদ্দ। সূত্র বলছে, আজ বৃহস্পতিবার বইমেলা পরিচালনা কমিটির বৈঠকে সেই ১৮টি প্রকাশনার মধ্যে একটির প্যাভিলিয়নের বরাদ্দ বাতিল, ৩টির প্যাভিলিয়নের আয়তন কমিয়ে ২৪ ফুট বাই ২৪ ফুট থেকে ২০ বাই ২০ ফুট করা এবং ১৪টি প্রকাশনা সংস্থাকে প্যাভিলিয়ন থেকে সরিয়ে ৩ থেকে ৪ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এই তালিকা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগপর্যন্ত এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

অমর একুশে বইমেলা–২০২৫ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়েছে, এবারের মেলায় কয়েকটি স্টল বাড়ানোর পরিসর আছে। ৫০ থেকে ৬০টি স্টল বাড়তে পারে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমিতে মেলার স্টল নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।