বাড়ির উঠানজুড়ে মানুষের ভিড়। রুমেলা বেগমের চোখ সেই ভিড়ের দিকে। ১০-১২ বছর বয়সী কোনো ছেলে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরছেন। বুকে নিয়ে তিনি বিলাপ করছেন, ‘এই না আমার বুকের ধন রুমান। আমার আরও দুই বুকের ধন কই? আমি আমার বাজানদের রাইখ্যা দেশে যামু না। আমার বাজানদের তোমরা আইনা দেও...।’
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সুরমা নদীতে গত সোমবার রাতে ট্রলারে আগুন লাগার ঘটনার পর থেকে রুমেলা বেগমের (৪০) নিখোঁজ তিন ছেলে রুমান (১২), সাকিব (৭) ও কোহিনুর (৬)। নিখোঁজ ছেলেদের জন্য স্ত্রী রুমেলাকে জড়িয়ে কাঁদছেন স্বামী কালু মিয়াও (৫০)। তাঁদের কান্নায় অশ্রুসিক্ত সেখানে উপস্থিত সবাই।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামে গিয়ে এই হূদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে।
ছাতকের নোয়ারাই ইউনিয়নের বেতুরা গ্রামের পাশে সুরমা নদীতে সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে যাত্রীবাহী একটি ট্রলারে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় গতকাল রাত পর্যন্ত ১১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হন আরও অন্তত ৪০ জন। তাঁদের মধ্যে ১৮ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা সবাই কমবেশি দগ্ধ হয়েছেন।
পুলিশের দাবি, নদীতে আর লাশ নেই। তাই গতকাল সকাল ১০টার পর তল্লাশি কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এ ঘটনায় আরও সাতজন নিখোঁজ রয়েছেন।
মনফর আলীর বাড়ির দৃশ্য: ঘটনাস্থলের কাছেই প্রতাপপুর গ্রামের মনফর আলীর (৬০) বাড়ি। সেখানেই ভিড় জমিয়েছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ওই বাড়িতে রুমেলার পাশেই মুঠোফোন কানে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন রুমা বেগম (৩৫)। কোলে শিশুসন্তান আছমা। মুঠোফোনে তিনি বলছিলেন, ‘ভাই রে, আমার সব শেষ হইয়া গেছে। আমার মার (মেয়ে হাসনা) মুখ-চোখ সব পুইড়া গেছে। এই পুড়া মুখ নিয়া আমি ক্যামনে দেশে আইমু ভাই। আমারে আইসা নিয়া যাও...।’
রুমেলা ও রুমা স্বামী-সন্তানদের নিয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ বালু-পাথর কোয়ারিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁদের বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার পাঁচহাতা গ্রামে। সোমবার রাতে ওই ট্রলারটিতে করে অন্য শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে তাঁরাও বাড়ি ফিরছিলেন। পথে ছাতকের বেতুরা গ্রামের পাশে সুরমা নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
রুমেলার স্বামী কালু মিয়া জানান, তিনি ট্রলারের ছাদে ছিলেন। আর রুমেলা সন্তানদের নিয়ে ছিলেন ভেতরে। আগুন ধরার পর তিনি ট্রলারের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুরো ট্রলারে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তিনি একসময় নদীতে ঝাঁপ দেন। এরপর নদীর তীরে উঠে দেখেন, রুমেলা একা। সন্তানেরা নেই।
রুমেলা জানান, ট্রলারের ভেতরের জানালাগুলো বন্ধ ছিল। তাই আগুন ধরার পরই ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময় তাঁর সন্তানেরা ঘুমিয়ে ছিল। তিনি কোনোমতে একটি জানালা খুলে বের হয়ে আসতে পারলেও সন্তানদের আনতে পারেননি।
খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুরের শ্রমিক ইয়াসিন মিয়া (৬০)। তাঁর সাত বছরের ছেলে তানিমও নিখোঁজ। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে, আমি বুঝে গেছি। বাড়িত গিয়া তার মায়ের কাছে কী জবাব দিমু আমি?’
যেভাবে দুর্ঘটনা: ট্রলারে থাকা শ্রমিক হাফছা বেগম (৩৮) জানান, তাঁরা ছাতক থেকে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ট্রলারে ওঠেন। ট্রলারের ভেতরে থাকা নারী ও শিশুরা ঘুমিয়ে ছিল। ট্রলারের ছাদে ছিলেন বেশির ভাগ পুরুষ। রাত সাড়ে আটটার দিকে ট্রলারের ভেতরের পেছন দিকে মাঝিরা তাঁদের রাতের খাবার রান্না করার জন্য একটি কেরোসিনের চুলায় আগুন ধরান। এ সময় চুলায় পাম্প করতে গেলে সেটিতে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে নৌকার ভেতরে আগুন ধরে যায়।
শ্রমিক ইয়াসিন মিয়া জানান, নৌকায় আগুন ধরার পর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাতাসে নৌকাটি ভেসে যায় নদীর দক্ষিণ পাড়ে। দক্ষিণ পাড় থেকে আবার যায় উত্তর পাড়ে। একপর্যায়ে এটি ডুবে যায়। নৌকায় আগুন ধরার পর সবাই চিৎকার শুরু করলে প্রথমে প্রতাপপুরের লোকজন এগিয়ে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। বাতাসে নৌকাটি আবার নদীর উত্তর পাড়ে গেলে বেতুরা গ্রামের লোকজন এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, ট্রলারে কিশোরগঞ্জের ইটনা ও নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি এলাকার শ্রমিকেরা ছিলেন। একসঙ্গে সবাই তাঁরা বাড়ি ফিরছিলেন।
লাশ শনাক্তের উপায় নেই: সুরমা নদীর যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার দক্ষিণ পারে দোয়ারাবাজারের প্রতাপপুর এবং উত্তর পারে ছাতকের বেতুরা গ্রাম। যে ট্রলারটিতে আগুন লেগেছে, সেটি বেতুরা গ্রামের পাশে নদীর ঘাটে রাখা। অর্ধেকটা পানির নিচে ডুবে আছে। ট্রলারের ছাদ নেই। পুরোটাই পুড়ে গেছে। নদীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসছে পোড়া কাঠের টুকরা। বেতুরা গ্রামে সুরমা নদীর তীরে ১০ জনের লাশ রাখা হয়েছে। আগুনে পুড়ে লাশগুলো একেবারে দলা পাকিয়ে গেছে। শনাক্ত করার উপায় নেই। একমাত্র শনাক্ত হওয়া রোকেয়া বেগমের (৩২) লাশ রাখা হয় প্রতাপপুর গ্রামের ফজর আলীর বাড়িতে।
সিলেট থেকে আসা দমকল বাহিনীর ডুবুরি দলের প্রধান জাবেদ হোসেন মুহামঞ্চদ তারেক জানান, সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান। রাত তিনটা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চালিয়ে তাঁরা নৌকার ভেতর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করেন। এরপর ঘন কুয়াশার কারণে উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ রাখা হয়। ভোর পাঁচটা থেকে আবার উদ্ধারকাজ শুরু হয়। তখন নৌকার ভেতর থেকে আরও পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ঘটনার পরপরই আরও তিনটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও গ্রামবাসী। তিনি বলেন, ‘লাশ শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। এমনকি নারী-পুরুষও বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাঁচ-ছয়জন শিশু রয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে।’
জাবেদ হোসেন মুহামঞ্চদ তারেক জানান, নৌকার ভেতরে আর কোনো লাশ নেই। তাই সকাল ১০টায় উদ্ধারকাজ বন্ধ করা হয়। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বিআইডব্লিউটিএর একটি ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। তারা আসার পর যৌথভাবে আরেকবার তল্লাশি চালিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বেতুরা গ্রামের নদীর তীরে রাখা লাশের পাশে কোনো স্বজনকে পাওয়া যায়নি। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিতে থাকা ছাতক থানার উপরিদর্শক (এসআই) হারুনুর রশিদ জানান, ঘটনার পর থেকেই তিনি সেখানে আছেন। দুর্ঘটনার শিকার লোকজন নদীর ওপারে প্রতাপপুরে রয়েছেন। তাঁরা ১০টি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এরপর প্রশাসন থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন: সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহামঞ্চদ ইয়ামিন চৌধুরী ও পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ সুপার জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ উদ্ধারকাজ তদারক করছে।
জেলা প্রশাসক জানান, নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে লাশগুলো স্থানীয়ভাবে দাফন করা হচ্ছে। এখনো কোনো লাশের স্বজনকে পাওয়া যায়নি। লাশের স্বজনের খোঁজ পেলে প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া আহতদের চিকিৎসায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
নৌপরিবহনমন্ত্রীর শোক: নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সুরমা নদীতে যাত্রীবাহী ট্রলারে আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন মন্ত্রী।