সাফারি পার্কের প্রাণীর মৃত্যু
১১টি জেব্রার শরীরেই বিষক্রিয়ার আলামত
১৩টি প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা। সিংহীর মৃত্যু যক্ষ্মায়, বাঘের মৃত্যু অ্যানথ্রাক্সে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে মৃত ১১টি জেব্রার শরীরে বিষক্রিয়ার আলামত পাওয়া গেছে। পার্কের ১৩টি বন্য প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাইট্রেট (বিষাক্ত উপাদান) বিষক্রিয়া ও মিশ্র ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে জেব্রাগুলোর মৃত্যু হতে পারে। আর সিংহী ও বাঘের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যথাক্রমে যক্ষ্মা ও অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
গতকাল রোববার মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক। পার্কে প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৬ জানুয়ারি ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে পাঁচটি গবেষণাগারে ওই ১৩টি বন্য প্রাণীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গবেষণাগারগুলো হলো সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার (সিডিআইএল), মৎস্য অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি এবং সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এবং সাফারি পার্কের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার, প্রাণীর উপসর্গ, সরেজমিন পরিদর্শনসহ বিভিন্ন বিষয় প্রতিবেদন তৈরিতে আমলে নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য প্রাণীগুলোর মৃত্যুর ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছাকৃত নয়, দুর্ঘটনাক্রমে বিষক্রিয়া হয়েছে—এমন বিবেচনা থেকে কাউকে দায়ী করেনি তদন্ত কমিটি।
সিংহীর মৃত্যুর বিষয়ে সাফারি পার্ক ও তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, পাখির একধরনের যক্ষ্মা রোগ হয়। একই ধরনের যক্ষ্মায় সিংহী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সপ্তাহে দু-একটি তাজা মুরগি খাওয়ানো হতো সিংহীকে। সেখান থেকে আক্রান্ত হতে পারে। সিংহীটি বেশ কয়েক মাস অসুস্থ ছিল। একপর্যায়ে সেটি মারা যায়।
সূত্র জানায়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ জেব্রার জন্য খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিপক্ব ঘাসের বদলে কচি ঘাস দেওয়ার নির্দেশনা দেয়। তারা জেব্রাগুলোকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রায় এক মাস এই কচি ঘাস খাওয়ায়। কিন্তু কচি ঘাসে নাইট্রেটের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এতে জেব্রাগুলো নাইট্রেট বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যেতে থাকে। শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর সংক্রমণও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২ থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে ১১টি জেব্রা মারা যায়।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলিজ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. আবদুল বাকী প্রথম আলোকে বলেন, নাইট্রেট শরীরে প্রবেশ করলে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয়। অনেক সময় অক্সিজেন ঘাটতির কারণে প্রাণীর মৃত্যু হয়।
সাফারি পার্কে বিদেশ থেকে আনা জেব্রার প্রজননের মাধ্যমে তাদের বংশবৃদ্ধি করা হয়। এখানে জন্ম নেওয়া জেব্রাগুলোর বড় অংশ ইনব্রিডিংয়ের (পরিবারের মধ্যে প্রজনন) মাধ্যমে হয়েছে। এভাবে জন্ম নেওয়া জেব্রার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। সেই সঙ্গে জেব্রাগুলো মারা যাওয়ার সময় বৈরী আবহাওয়া ছিল। পাশাপাশা প্রাণীগুলোকে দানাদার খাবারও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জেব্রাগুলোর মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিষক্রিয়ার পাশাপাশি এসব বিষয়ও কারণ হিসেবে দেখেছে তদন্ত কমিটি।
সাফারি পার্কে জীবিত থাকা জেব্রাগুলো সম্পর্কে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য বলেন, ২০ জানুয়ারির পর থেকে জেব্রাগুলোর কচি ঘাস খাওয়ানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘাসগুলো পানিতে ভিজিয়েও খাওয়ানো হচ্ছিল। দানাদার খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোধে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে বাকি জেব্রাগুলো স্বাভাবিক হয়েছে।