চার মাস হয়ে গেলেও রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের টিকিট ঘরে কর্মচারী ইসরাফিল হোসেন হত্যা মামলার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও হত্যাকারীর পরিচয় এবং এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নিহত ইসরাফিল হোসেনের পরিবার আবেদন করে মামলাটি রেল পুলিশ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করায়। কিন্তু তারাও তদন্তে বিশেষ অগ্রগতি করতে পারেনি। পরিবার দাবি করেছে, মামলা তদন্তে অনীহার কারণে রেলওয়ে থানার পুলিশই তাদের দিয়ে ওই আবেদন করিয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই গত রোববার মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোর কাছে দাবি করে বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যেই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করব।’
গত বছরের ৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে কমলাপুর স্টেশনের সুরক্ষিত টিকিট কাউন্টারের ভেতরে খুন হন প্রবীণ কর্মচারী ইসরাফিল। পরদিন সকালে সেখান থেকে পুলিশ তাঁর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে। খুনিরা টিকিট বিক্রির প্রায় ১৭ লাখ টাকাও নিয়ে যায় বলে তখন কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করে। এ ঘটনায় স্টেশন মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। শুরু থেকেই ইসরাফিলের পরিবার দাবি করে আসছে, এ হত্যায় রেলের অভ্যন্তরীণ কেউ জড়িত।
ঘটনার পর পুলিশ মো. লিটন ওরফে কাটা লিটন নামে সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেপ্তার করে। তখন পুলিশ জানায়, লিটন রেলওয়ের কোনো কর্মচারী নন। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কক্ষে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল।
লিটনকে গ্রেপ্তারের পর তদন্ত দৃশ্যত থমকে যায়। কিছুদিন পর পরিবার মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর আবেদন করে। এর কয়েক দিন পর তা সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত ইসরাফিলের পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, রেল পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই পরিবারকে দিয়ে মামলা স্থানান্তরের আবেদন করান। ওই কর্মকর্তারা বলেন, এ মামলার তদন্ত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা কমলাপুর রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতিবিধি ও আচার-আচরণের ভিত্তিতে রেলের ভেতরকার কয়েকজন সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। টাকা লুটের উদ্দেশ্যে এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেই এ হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে মামলার তদন্ত সুষ্ঠুভাবে চালানো যায়নি। তবে রেল পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলের কর্মীদের মধ্যে সন্দেহভাজনদের আটক করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এ আশঙ্কায় পুলিশ ‘ঝুঁকি নিতে’ চায়নি।
পুলিশের রেলওয়ে রেঞ্জের বর্তমান উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান বলেন, ‘তদন্তে পুলিশের অনীহা ছিল, এ কথা ঠিক নয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে।’
রেল কর্তৃপক্ষের ‘অসহযোগিতার’ বিষয়ে রেল পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার অভিযোগ এবং কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মকবুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগ দিয়েছি। এ মামলার ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। পুলিশ তদন্ত করছে।’
আরও দুজন গ্রেপ্তার: মামলার দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি ইলিয়াস খাঁ ও আবদুর রাজ্জাক নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী ইলিয়াস টিকিট কালোবাজারি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। আর হত্যাকাণ্ডের আগে রেলওয়ের একটি মেরামতি কাজ করেছিলেন রাজ্জাক। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের বিষয়ে জানতে চাইলে মেজবাহ উদ্দিন বলেন, হত্যাকাণ্ডে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন আরও দুজনকে খোঁজা হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ কেউ জড়িত কি না জানতে চাইলে পরিদর্শক মেজবাহ বলেন, ‘পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, হত্যাকারীরা ইসরাফিলের পূর্বপরিচিত ছিল। ইসরাফিল ধূমপান করতেন না। কিন্তু টিকিট ঘরে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। ওই অবশিষ্টাংশসহ কিছু আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।