বঙ্গোপসাগরে তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে টানতে দরকার সম্ভাব্য খনির বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য। সাগরে বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনার মাধ্যমেই সেই তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে। সাত বছর আগে এ প্রক্রিয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো জরিপ শুরু হয়নি। এর জন্য গ্যাস আমদানিতে নগদ কমিশনপ্রাপ্তি এবং পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে কোনো কোনো পক্ষের অপতৎপরতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালেই সমুদ্রে জরিপ চালিয়ে তথ্য নিয়েছে মিয়ানমার। আর দেশে অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত করে গ্যাস আমদানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। তারাই নানা অজুহাতে সমুদ্রে জরিপের কাজটি পিছিয়েছে। পছন্দের কোম্পানি জরিপের কাজ না পাওয়ায় তদবির করে আবার দরপত্র করিয়েছে আরেকটি চক্র। মাঝে তারা সরকারিভাবে জরিপের প্রস্তাবও দিয়েছিল। জাহাজ কিনে নিজেরা জরিপ করতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করেছিল জ্বালানি বিভাগ। পরে এটি বাতিল করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে সাগরে বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় পেট্রোবাংলা। পরের বছর ২০১৫ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ১৫ দিনের মধ্যে দরপত্র মূল্যায়ন করে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। এর কিছুদিন পর আবার দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয় জ্বালানি বিভাগ। ২০১৬ সালে পুনঃ দরপত্রে একই কোম্পানি নির্বাচিত হয়। গত বছরের মার্চে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, চুক্তি অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে জরিপের কাজটি করবে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রান্সের কোম্পানি স্লাম বে জ্যে–এর যৌথ কনসোর্টিয়াম। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির কাছে জরিপের তথ্য বিক্রি করে তাদের বিনিয়োগের টাকা তুলে আনবে। চুক্তি অনুসারে এক বছরের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা ছিল। আর এর পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জরিপ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত মার্চে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে কনসোর্টিয়াম। সমুদ্রের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় দ্বিমাত্রিক জরিপ চালানোর কথা তাদের। কাজ শুরু করতে গত সপ্তাহে পরিবেশগত ছাড়পত্রও নিয়েছে তারা।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালের দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে প্রথম হয় টিজিএস-স্লাম বে জ্যে। এটি বাতিল করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। পরের বছর আবার প্রথম হয় টিজিএস-স্লাম বে জ্যে। এরপর দরপত্র মূল্যায়ন করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ৯ মাস পর প্রতিবেদন দেয় তারা। ২০১৯–এর এপ্রিলে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেওয়ার প্রায় এক বছর পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিষয়টি এত দিন ঝুলে থাকার কারণ জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, দরপত্র নিয়ে অভিযোগ এলে তা তদন্ত করতে হয়েছিল। দরপত্র, পুনঃ দরপত্র প্রক্রিয়ায় পিছিয়েছে, এটা ঠিক। এরপর চুক্তি হলেও করোনার কারণে ওরা (টিজিএস-স্লাম বে জ্যে) আসতে পারেনি। তবে কাজ কিছুটা এগিয়েছে। নভেম্বরেই কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এখন আবার কিছুটা খারাপের দিকে। সমুদ্রে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করার দরপত্র ঝুলে আছে। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পাচ্ছে না টিজিএস-স্লাম বে জ্যে। জরিপের জন্য জাহাজ ঠিক করা হয়নি। তাই তারা এখনো জরিপ শুরুর নির্দিষ্ট সময় জানায়নি। আগামী জানুয়ারির দিকে শুরু হতে পারে।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ মানচিত্র বলছে, বঙ্গোপসাগরে সব মিলে ব্লক (অনুসন্ধান এলাকা) আছে ২৬টি। এর মধ্যে অগভীর সমুদ্রে ১১টি আর গভীর সমুদ্রে ১৫টি। গভীর সমুদ্রে এখন কোনো কাজ চলছে না। সব মিলে ২৪টি ব্লক এখন খালি পড়ে আছে।
২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এর আগে–পরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও নানা কারণে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। বঙ্গোপসাগরে ২৬টি ব্লকের দুটিতে এখন অনুসন্ধানকাজ করছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড। জরিপ শেষ হলেও নির্ধারিত সময়ে কূপ খনন করতে পারেনি তারা। নতুন করে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়েছে।
জ্বালানিসচিব বলেছেন, গত বছর জুলাইয়ে পিএসসি-২০১৯–এর জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি ছিল। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, মজুত কমে আসায় এক বছর ধরে গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। সামনে এলএনজি আমদানি আরও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র, পুনঃ দরপত্রের নামে দীর্ঘসূত্রতা ইচ্ছাকৃত মনে হয়। উদ্যোগের বদলে বাধাগ্রস্তের চক্রান্ত। এলএনজি আমদানিতে নগদ কমিশন–বাণিজ্যের সুযোগ নিতেই একটি চক্র অনুসন্ধানে অনাগ্রহ তৈরি করছে। এ দীর্ঘসূত্রতার তদন্ত করা উচিত। আর এ শুষ্ক মৌসুমেই কাজ শুরুর জোর তৎপরতা নেওয়া দরকার। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিয়ানমার-ভারত ইতিমধ্যে অনুসন্ধানে গ্যাস পেয়েছে।