সাক্ষীর ঘরে তালা, আতঙ্ক
রাউজানের জগৎমল্লপাড়ার শহীদবেদিতে দীর্ঘদিন পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া লাগেনি। গাছের পাতা আর আগাছায় ভর্তি হয়ে আছে সেটি। এই পাড়ার ৩৬ জন শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে বছর চারেক আগে বেদিটি বানানো হয়েছিল। সেই হত্যাযজ্ঞের রায়ের দিনেও বেদিটি পরিষ্কারের সাহস করতে পারেনি শহীদদের উত্তারিধাকারীরা। গতকাল জগৎমল্লপাড়া পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। প্রতিটি ঘরের দরজা ছিল বন্ধ। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস গহিরার পার্শ্ববর্তী গ্রাম জগৎমল্লপাড়া। সংখ্যালঘু এই পাড়ায় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
জগৎমল্লপাড়া হত্যাযজ্ঞের সেই অভিযোগে সাকা চৌধুরীর ২০ বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলার অন্যতম সাক্ষী আশীষ চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁর ঘরে তালা ঝুলছে। এর আগের দিন সোমবার ঘরের সামনে কথা হয়েছিল আশীষ চৌধুরীর স্ত্রী মেরী চৌধুরীর সঙ্গে। আশীষের ভাই পার্শ্ববর্তী ঘরের বাসিন্দা অজয়ের ঘরও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পুরো পাড়ার বাড়ির আঙিনায় কোনো নারী-পুরুষের দেখা মেলেনি। এমনকি শিশুদেরও দেখা যায়নি। ৪২ বছর আগের সেই আতঙ্ক যেন এখনো কাটেনি জগৎমল্লপাড়ার।
হঠাৎ করে আন্না চৌধুরী নামের এক নারীর দেখা মেলে ক্ষণিকের জন্য। তিনি বলেন, ‘কে কোথায় জানি না। আমার স্বামী চাকরিতে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের সেই হত্যাযজ্ঞের পর থেকে এখানকার সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে দিন কাটাত। সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর এমনটি জানালেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল শাহ মিয়া। তিনি বলেন, ‘একাত্তরের পর ১৯৭৫-এর পর থেকে সাকা চৌধুরীর অত্যাচার বেশি হয়েছে এখানে।’ একই আতঙ্ক ভর করেছে ঊনসত্তরপাড়া এলাকায়। শহীদ পরিবারের কেউ প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি। ১৯৭১ সালে সবচেয়ে বেশি ৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। এই অভিযোগের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সুজিত মহাজন। তিনি তাঁর বাবা যোগেশ চন্দ্র মহাজন ও ভাই রণজিত মহাজনকে হারিয়েছেন সেদিন।
ঊনসত্তরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাঁদের একটি দোকান রয়েছে। দোকানে খোঁজ নিলে সুজিতের ভাই পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, ‘আমার ভাই সোমবার থেকে নেই। আমরা কিছু বলতে পারব না। এমনিতে নানা সমস্যায় আছি।’ দোকানের সামনে শহীদবেদি। এর পাশে পুলিশের পাহারা। তবু এত ভয় শহীদস্বজনদের। এই ভয়ের কারণেই কিনা শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় বেদিতে একটি ফুলও দেওয়া হয়নি!