সাঁতার কেটে প্রতিবন্ধিতা জয়
ঘর থেকে একটু এগোলেই পুকুর। এই পুকুরে বাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়ে গোসল করে। সাঁতার কাটে। হুইলচেয়ারে বসে ছেলেমেয়েদের দুরন্তপনা দেখা ছাড়া একসময় আর কিছুই করার ছিল না রুবেলের। সাঁতার কাটা দেখে প্রায়ই রুবেল ফিরে যেতেন তাঁর স্বাভাবিক জীবনের সোনালি অতীতে—যখন তিনি খাল–বিলে সাঁতার কেটে দিন পার করতেন, তুলে আনতেন শাপলা-শালুক।
কিন্তু ১০ বছর ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না রুবেল। সাঁতার কাটার স্বপ্ন দেখারও আর সাহস পাননি। কিন্তু হুইলচেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারলেও এক বছর আগে রুবেলের সেই সাঁতার কাটার ইচ্ছে পূরণ হয়। তিনি এখন সাঁতার কাটেন অন্য সব স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের সঙ্গী হয়ে।
শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবকের এই স্বপ্ন জয়ের গল্প কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া ইউনিয়নের ইকরআটিয়া গ্রামের।
ইচ্ছে পূরণে সাহস জোগায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স’। মূলত, এই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় শুধু রুবেল নন, আরও দুই প্রতিবন্ধী একই সঙ্গে সাঁতার কাটছেন। একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার জন্য তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করছেন।
রুবেল ইকরআটিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পুরো নাম রফিকুল ইসলাম। ছোটবেলা থেকে তিনি শান্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলে হিসেবে পরিচিত। সাঁতার কাটা তাঁর বেশ পছন্দ। আবার দাঁড়িয়াবান্ধা বা গোল্লাছুটেও তাঁকে হার মানানো দায় ছিল। পেশায় ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাততলা থেকে ছিটকে পড়ে স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা হারান রুবেল। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে তিনি প্রতিবন্ধী জীবন কাটাচ্ছেন। এই দুঃসময় আর দুরবস্থার মধ্যেও সাঁতার কাটতে পারার আনন্দ তাঁকে কিছুটা স্বস্তি জোগায় বলে জানিয়েছেন রুবেল।
সম্প্রতি ইকরআটিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় রুবেলের মতো তিন সাঁতারযোদ্ধার সঙ্গে। আলাপচারিতায় জানা গেল তাঁদের নানা কষ্টগাথা। আবার কষ্ট জয়ের গল্প। রুবেলের সঙ্গে সাঁতার কাটছেন প্রতিবন্ধী মো. হুমায়ুন ও জসিম উদ্দিন। হুমায়ুন একই উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের উজানচর গ্রামের আর জসিম হিলোচিয়া ইউনিয়নের পুড্ডা গ্রামের বাসিন্দা।
হুমায়ুন এখন ৩২ বছর বয়সী এক যুবক। তাঁর প্রবাস জীবন ছিল। ২০০৯ সালে বিদেশে মোটরবাইক দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি স্বাভাবিক চলাফেরায় অক্ষম। সঙ্গী এখন হুইলচেয়ার।
২৭ বছর বয়সী জসিম ছোটবেলায় গোল্লাছুট খেলায় পারদর্শী ছিলেন। এই খেলায় পারদর্শিতার কারণে গ্রামের মানুষের নজর কেড়েছিলেন তিনি। তাঁর দুরন্ত জীবন থেমে যায় টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে। সাত বছর বয়সে জসিম এই রোগে আক্রান্ত হন। রোগ সেরে যাওয়ার পর চলাফেরা ও খেলাধুলা—সবই করতে পারতেন। পরে ধীরে ধীরে তিনি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
জসিম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জীবন খুবই কষ্টের। পদে পদে অবহেলা। অপরিচিত লোকজন যেন কেমন করে তাকায়। এই জন্য সুস্থ মানুষ দেখলে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করি। আর খাল-বিল দেখলে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে।’ অনেক না পাওয়ার মধ্যে সাঁতার টাকার ইচ্ছে পূরণ এখন কিছুটা হলে ব্যক্তিজীবনের জনবিচ্ছিন্নতা কমিয়ে এনেছে বলে মনে করেন জসিম।
এই দেশে প্রতিবন্ধীদের মন ভালো রাখার সুযোগ নেই—কষ্ট নিয়ে বললেন হুমায়ুন। স্বাভাবিক জীবনে অনেক বন্ধু থাকলেও প্রতিবন্ধী হওয়ার পর একা হয়ে যেতে হয়। হুমায়ুন জানান, পঙ্গু হওয়ার পর ২০১০ সালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হন ঢাকার অদূরে সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। সেখানে গিয়ে হুমায়ুন দেখতে পান, তাঁর মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী খেলাধুলা করছেন। হাসছেন। গল্প করছেন। তখন তাঁর মনেও খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ জাগে। পরে তিনি সিআরপিতে হুইলচেয়ারে বসে গোলক নিক্ষেপ ও বাস্কেটবল খেলায় অংশ নিতেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি নেটওয়ার্ক (এসকন) প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বাস্কেটবল দল ভারত, নেপাল ও মালয়েশিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই দলে হুমায়ুনও ছিলেন একজন। একই প্রতিযোগিতায় ভারোত্তলনে তিনি তৃতীয় হন। এখন তাঁর সব স্বপ্ন সাঁতারকে ঘিরে। রুবেল ও জসিমের সঙ্গে হুমায়ুনও নিয়মিত সাঁতার কাটছেন।
হুমায়ুন জানালেন, খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার পর এখন তাঁর মনের জোর বেড়েছে। পাচ্ছেন মানসিক শান্তি। সবচেয়ে বড় কথা, বন্ধুত্বের শূন্য তালিকা এখন আর শূন্য নেই। কারণ, খেলাধুলায় মাধ্যমে হুমায়ুন অনেক বন্ধু পেয়েছেন। তাঁর মতে, খেলাধুলায় বন্ধু বাড়ে। একই সঙ্গে বাড়ে সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ।
সাঁতার নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী রুবেল। এসকন প্রতিযোগিতায় হুমায়ুনের সঙ্গে রুবেলও ছিলেন। এখন সাঁতার দিয়ে কিছু করে দেখানোর ইচ্ছে রয়েছে তাঁর।
রুবেল বলেন, ‘সাঁতার কাটতে পারব নিজের যেমন বিশ্বাস হতো না, তেমনি প্রতিবেশীদের কাছেও অবিশ্বাস্য ছিল। এখন যখন সাঁতার দিয়ে এক নিশ্বাসে প্রান্ত বদল করতে পারি, তখন নিজের কাছেও বিশ্বাস হতে চায় না। আমাদের এই মানসিক শক্তি দেখে অনেকে এখন বুকে জড়িয়ে ধরেন। ছবি তুলতে আসেন।’ খেলাধুলার মাধ্যমে কষ্ট ও বঞ্চনার প্রতিবন্ধী জীবনের কিছুটা হলেও ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব বলে মনে করেন রুবেল।
তাঁদের তিনজনের বক্তব্যের এক জায়গায় মিল রয়েছে। তা হলো সাঁতারকে তাঁরা জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। দেশের জন্য কুড়িয়ে আনতে চান বিরল সম্মান। একই সঙ্গে তাঁরা জানালেন নানান সীমাবদ্ধতার কথা। তাঁরা এখন যে পুকুরটিতে সাঁতার কাটছেন, সেখানে ওঠানামা খুবই কষ্টের।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স (শি) প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া উন্নয়ন প্রধান পাপ্পু লাল মোদকের সঙ্গে। সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেন তিনিও নিজেও। পাপ্পু জানালেন, ধীরে ধীরে সুযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তাঁদের কোচ নিয়োগ করা হয়েছে। আবুল হাসেম নামের একজন ভালো মানের কোচের তত্ত্বাবধানে তাঁরা সাঁতার কাটছেন। প্রাথমিকভাবে ফ্রি স্টাইল ও ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারে তাঁদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।
স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স বা শি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা শারমিন ফারহানা চৌধুরী। বর্তমানে তিনি শির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জানালেন, খেলাধুলায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজের ভাবনা থেকেই এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন তিনি। প্রতিবন্ধীদের সাঁতার নিয়ে অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্নও তাঁর কথায় ফুটে উঠেছে।
শারমিন ফারহানা চৌধুরী জানান, খেলাধুলা সবার জন্য—এই প্রতিষ্ঠান মূলত এই ভাবনা নিয়ে কাজ করে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে খেলাধুলার কাজটি করা অত্যন্ত কঠিন। সেই ‘কঠিন’কে জয় করার চেষ্টা করছে এই প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালে জাপানের টোকিওতে প্যারালিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে। তাঁদের ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
শারমিন ফারহানা চৌধুরী আরও জানান, প্রতিবন্ধী সাঁতারুদের উজ্জীবিত করার জন্য তাঁদের সঙ্গে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের অ্যাডাপটিভ অ্যাথলেটিকসের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাইকেল কোটিংহাম। অধ্যাপক কোটিংহাম নিজেও হুইলচেয়ারে চলাচলকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
ইকরআটিয়া গ্রামে প্রতিবন্ধী সাঁতারুদের সঙ্গে সাঁতারের নানান কৌশল নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় ড. মাইকেল কোটিংহামকে। সে সময় তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে খেলাধুলার ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সামাজিক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ডিজঅ্যাবিলিটি স্পোর্টস ব্যবহার করা যেতে পারে।