যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র
সহিংসতা ও অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধে উদ্যোগ কম
দ্রুত জামিন না পাওয়া ও স্বজনেরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না করায় শিশুরা হতাশ হয়ে পড়ছে।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন শিশুকে পিটিয়ে হত্যার দেড় বছর পার হলেও এখনো বিচারকাজ শুরু হয়নি। এর মধ্যে গত সোমবার কেন্দ্র থেকে জহুরুল ইসলাম (১৬) নামের এক কিশোরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত এক দশকে কেন্দ্রটিতে অন্তত চারবার বিদ্রোহ, সহিংসতা ও বন্দীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৬ কিশোর নিহত ও ১৫ কিশোর আহত হয়েছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে তদন্ত কমিটি নানা সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে খুবই কম।
সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক অসীত সাহা প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত জামিন না পাওয়া ও স্বজনেরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না করায় শিশুরা হতাশ হয়ে পড়ছে। মানসিক চাপের কারণে তারা হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে একাধিক মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক থাকা জরুরি। এ ছাড়া অন্যান্য জনবলসংকটও দূর করতে হবে।
মানসিক চাপের কারণে তারা হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে একাধিক মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক থাকা জরুরি।
সর্বশেষ তিন শিশু হত্যার মামলায় ১২ জনের নামে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ, তাঁদের মধ্যে ৪ জন কেন্দ্রের কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কেন্দ্রের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর এ কে এম শাহানুর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ইদ্রিস আলী বলেন, অভিযোগপত্র ও দোষীপত্র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে।
মামলা ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রের প্রধান প্রহরী নূর ইসলামকে মারপিটের জেরে ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট কেন্দ্রের ১৮ শিশুকে কর্মকর্তাদের নির্দেশে নির্যাতন করা হয়। এতে বগুড়ার শিবগঞ্জের নান্নু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন, খুলনার দৌলতপুরের রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান ওরফে রাব্বি ও বগুড়ার শেরপুরের নুরুল ইসলামের ছেলে রাসেল হোসেন মারা যায়। গুরুতর আহত হয় আরও ১৫ জন। এ ঘটনায় নিহত পারভেজ হাসানের বাবা রোকা মিয়া যশোর কোতোয়ালি থানায় ১৩ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
সোমবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে জহুরুল ইসলামের (১৬) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, জহুরুল আত্মহত্যা করেছে। এর আগে নূর ইসলাম (১৫) নামের আরেক শিশু আত্মহত্যা করে। জহুরুল পাবনার বামুনডাঙ্গা গ্রামের জিলাল মণ্ডলের ছেলে। তার মামা জিয়াউর রহমান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে আমার ভাগনে মারা গেছে, তা বলতে পারি না। তবে তার শরীরে আঘাতের কোনো দাগ দেখা যায়নি। এ জন্য সে আত্মহত্যা করতে পারে বলে সবাই ধারণা করছে।’ কেন সে আত্মহত্যা করতে পারে জানতে চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ঘটনার আগের দিন জহুরুল তার মামা আলতাফ হোসেনের কাছে কয়েকবার ফোন দেয়। কিন্তু আলতাফ ফোনটা ধরতে পারেননি। জামিনেও তার মুক্তি মিলছিল না। এসব কারণে হয়তো হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করতে পারে।
ছয় শিশুর প্রাণহানি
১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের আদালতের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সংশোধনের জন্য তাদের পাঠানো হলেও শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় তারা আরও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। কেন্দ্রের নিবাসীদের মধ্যে ৬০ ভাগ হত্যা মামলার আসামি। কিন্তু গুরুতর অপরাধে জড়িত শিশুদের কেন্দ্রে আলাদা রাখার ব্যবস্থা নেই। এ জন্য ছোট অপরাধে অভিযুক্ত শিশুরা বড় অপরাধে জড়িত শিশুদের সঙ্গে মিশে অপরাধের কৌশল শিখছে। ১৫০ জন ধারণক্ষমতার এ কেন্দ্রে এখন বন্দী রয়েছে ২৯২ জন।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১০ জুলাই শিশুরা দিনব্যাপী কেন্দ্রে তাণ্ডব চালায়। ওই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে কেন্দ্রের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ২৪টি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ওই সুপারিশগুলোর মধ্যে দু–একটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অপর সুপারিশগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তরে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে চিঠিতে বলা হয়।
ব্যবস্থাপনায় সুপারিশ বাস্তবায়ন কিঞ্চিৎ
জহুরুলের লাশ উদ্ধারের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহকারী সচিব মাহমুদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জেলা প্রশাসনের সুপারিশ ছিল—শিশুদের পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করতে খাবারের বরাদ্দ বর্তমানের চেয়ে দেড় গুণ বৃদ্ধি করা। সেই সুপারিশ অনুযায়ী ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে খাবারের বরাদ্দ জনপ্রতি ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়।
প্রয়োজনে প্রতিটি বিভাগে একটি করে কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতির বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে কাজ চলছে। অপর সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে চিঠিতে বলা হয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাকি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক অসীত সাহা বলেন, সুপারিশ ছিল দুই ধরনের—স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কেন্দ্রে জনবলসংকট ও অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা থেকে গেছে। ৪৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ২৬ জনকে দিয়ে কেন্দ্রটি চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।