নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েই মঙ্গলবার আত্মগোপনে যান জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। এর ২৬ ঘণ্টা পর গতকাল বুধবার বিকেলে নিজ বাসায় ফিরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরই নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয়’ সরকার ছাড়ার ঘোষণা দিলেন তিনি।
সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে এরশাদ সংবাদ ব্রিফিং করে বলেন, তিনি নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা জাপার সব মন্ত্রী-উপদেষ্টাকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করারও নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি আমার দলের প্রার্থীদের ঘোষণা দিচ্ছি, তোমরা মনোনয়নপত্র তুলে নাও। তোমাদের জীবনকে বিপন্ন করো না।’
এ সময় এরশাদ বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তাতে জাতীয় পার্টিকে অংশ নিতে বৈঠকে তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন সুজাতা সিং। জবাবে তিনি বলেছেন, দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
পরে রাতে এরশাদের বাসায় বৈঠক শেষে জাপার মহাসচিব বিমানমন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেছেন, আজ বৃহস্পতিবার জাপার সব মন্ত্রী-উপদেষ্টা একযোগে পদত্যাগ করবেন।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদ দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দিলেও তাঁদের দু-একজন থেকে যেতে চান। তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে এরশাদকে বোঝানোর পাশাপাশি চাপ প্রয়োগ করে অবস্থান পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা একপর্যায়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রওশন এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে এসে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। র্যাব-পুলিশের উপস্থিতির কথাও জানানো হয়। এ পর্যায়ে এরশাদ বলেন, গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেও ভালো, অন্তত মানুষ থুতু দেবে না, পত্রিকায় আর কার্টুন ছাপা হবে না।
জাপার নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়ার ঘোষণার বিষয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে, এরশাদের এই ঘোষণার পরপর বিপুলসংখ্যক র্যাব, পুলিশ ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা বারিধারায় এরশাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত সাড়ে ১২টায় এ খবর লেখা পর্যন্ত ঘেরাও বহাল ছিল।
রাতে আত্মহত্যার হুমকি: রাত সাড়ে ১১টায় এরশাদ বাসার নিচতলায় এসে সাংবাদিকদের বলেন, চারটা পিস্তল ‘লোড’ করে রেখেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে আত্মহত্যা করবেন। তিনি বলেন, ‘র্যাব-পুলিশ আমার গায়ে হাত দেওয়ার আগে আমি মরে যাব। সরকারকে বলে দিয়েছি, কোনো চালাকি করলে চারটা পিস্তল আছে, আমার কাছে যাওয়ার আগেই এগুলো দিয়ে আমি সুইসাইড করব। দিস ইজ মাই প্রমিজ।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা: ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বের হয়ে যাওয়ার পরপরই পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য এরশাদের বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্ক ঘেরাও করে ফেলেন। এ সময় সেখানে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আকবর হোসেন, পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিরাজুল ইসলাম শিকদার, র্যাব-১-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমত হায়াতসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত হন। অবশ্য রাত ১০টায় পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চলে যান।
অবশ্য সন্ধ্যায় কিসমত হায়াত সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, এটা কূটনৈতিক এলাকা। এখানে লোক সমাগম বেশি হওয়ায় কূটনীতিকদের অনুরোধে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার দুপুরে আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে এরশাদ আত্মগোপনে যান। গতকাল বেলা সোয়া তিনটার দিকে তিনি একটি মাইক্রোবাসযোগে এসে পেছনের দরজা দিয়ে বাসায় ডোকেন। এর আগে বাসার সামনে দলের কয়েক শ নেতা-কর্মী জড়ো হন। বিকেল চারটার দিকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন। এরশাদ ও সুজাতা সিং প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন।
একটি সূত্র জানায়, আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশের অবস্থা বোঝাতে এরশাদ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি কার্টুন দেখান।
বৈঠকে জাতীয় পার্টির কোনো নেতাকে রাখা হয়নি। অবশ্য তখন নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা জাপার চার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা রুহুল আমিন হাওলাদার, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, মুজিবুল হক এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ নিচতলার অভ্যর্থনাকক্ষে বসে ছিলেন।
এরশাদ-সুজাতার কথোপকথন: বিকেল পাঁচটায় এরশাদ বাসার নিচতলায় সংবাদ ব্রিফিং করে বলেন, তিনি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে বলেছেন, দেশের যে অবস্থা, তাতে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে-গঞ্জে। তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না। কোনো প্রার্থী এলাকায় যেতে পারবেন না। এই অবস্থায় নির্বাচন করা কঠিন হবে, সম্ভব হবে না।
এরশাদ জানান, সুজাতা সিং তাঁকে বলেছেন, জাপা নির্বাচনে না গেলে যদি অন্য কোনো দল জয়ী হয়, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান হবে। এরশাদ দাবি করেন, এ সময় তিনি বলেছেন, তিনি জামায়াতের উত্থান হোক, তা চান না। যদি জামায়াতের উত্থান হয়ও, তার জন্য দায়ী হবে বর্তমান সরকার। এখন দেশের যে অবস্থা, তাতে নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
এরশাদ বলেন, এ পর্যায়ে সুজাতা সিং বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক ভালো কাজ করেছেন। জবাবে এরশাদ বলেন, হ্যাঁ, অনেক ভালো কাজ করেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ঠিক করেননি তিনি। সব খাতকে হত্যা করেছেন উনি। দেশের মানুষ ওনার পক্ষে নেই আজ।
এরশাদ আরও বলেন, তিনি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে বলেছেন, আপনি রাস্তায় যান, ১০০ লোককে জিজ্ঞাসা করেন। একটা মানুষও শেখ হাসিনার পক্ষে কথা বলবেন না। এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে দেশে আজ। তখন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের এখনো সময় আছে। দেখেন, পরিস্থিতির উন্নতি হয় কি না। জবাবে এরশাদ বলেন, দেখা যাক অবস্থার উন্নতি হয় কি না, মনে হয়, আরও খারাপ হবে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে এরশাদ ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘উনাদের ইচ্ছা, নির্বাচন হোক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হোক। সে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার আসবে, তাদের মানবেন। আমি বলেছি, সে সুযোগ আর নেই, সেটা হওয়া সম্ভব না।’
এরশাদ সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমি আমার জীবনের শেষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করব না। সব দল না আসলে আমি নির্বাচনে যাব না, এটা আমার শেষ কথা। নির্বাচনে যাব না, যাব না।’ তিনি বলেন, ‘আশা করেছিলাম, সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, এখন সেই আশা দুরাশা।’
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন গত রোববার। ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বাংলাদেশ সফর সামনে রেখে তিনি মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন। তবে ঠিক কী কারণে এরশাদ আকস্মিক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়।