সরকারি চাকুরে হলেও তাঁদের নেই কোনো ছুটি
সরকারি চাকুরে হলেও কোনো ধরনের ছুটি তাঁরা পান না। রাতে দায়িত্ব পালনের পর দিনের বেলায়ও করতে হয় অফিস। যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা হলেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জেলা কার্যালয়ের নিরাপত্তাপ্রহরী। শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটিও তাঁদের নেই। এ জন্য বাড়তি কোনো পারিশ্রমিকও পান না তাঁরা।
নির্বাচন কমিশনের ৬৪টি জেলাতেই কার্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে আরও ১০টি। জেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রতিটিতে একজন করে নিরাপত্তাপ্রহরীর পদ রয়েছে। তবে এখনো কয়েকটি জেলায় এই পদ ফাঁকা।
দেশের একটি জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে নিরাপত্তাপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন মো. আল আমিন (ছদ্মনাম)। জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের কাছেই স্ত্রী ও সন্তানের থাকার জন্য বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকা হয় না। রাত ও দিন সেখানেই কেটে যায় তাঁর। কেবল খাওয়া ও গোসলের জন্য বাসায় যেতে পারেন। তবে এ সময়টুকুতে কিছু হারালে বা ক্ষয়ক্ষতি হলে সে দায়ভারও তাঁর ওপরে বর্তাবে।
আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিসের সবাই শুক্র, শনি ও অন্যান্য সরকারি ছুটি পেলেও আমি পাই না। যদি বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন আবেদন করলে স্যার তিন থেকে চার দিনের ছুটি দেন। এটুকুই।’ ছুটি চাইতে গেলে অনেক সময় কথাও শুনতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু স্যার বলেন যে তুমি তো নিরাপত্তাপ্রহরী, তোমার আবার ছুটি কিসের?’
অমানবিক জীবন যাপন করছেন উল্লেখ করে আল আমিন বলেন, ‘ঈদে যদি ছুটি চাই, তখন স্যার বলেন অফিস দেখবে কে? ঈদের সময় পরিবার-পরিজন বাসায় থাকে, আমি এখানে থাকি। এটা কি হয়? এটা কোনো জীবনের মধ্যে পড়ে না।’
নড়াইল জেলা নির্বাচন কার্যালয়েও একজন নিরাপত্তাপ্রহরী রয়েছেন। এই জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ওয়ালিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে তো আর ওইভাবে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে না। রাতে আসে, সকালে চলে যায়। বাদবাকি সময় ঐচ্ছিক। তবে আমার এখানে যে আছে, সে বলে যে বাসায় কী করব, তাই চলে আসে। চা-টা খাইল, অফিসের কাজও করল।’
মো. ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ‘তার যখন ছুটি লাগে, চাইলে দিই। তখন অফিস সহায়ক বা আউটসোর্সিংয়ে যারা আছে, তাদের দায়িত্ব দিই।’
ইসির নিরাপত্তাপ্রহরীদের এভাবে কাজ করানো দেশের বিদ্যমান আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১০০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে সাধারণত দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করবেন না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না।’
এই আইনের ১০৮ নম্বর ধারার ১ উপধারায় বলা আছে, ‘যে ক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি কাজের জন্য মূল মজুরি ও মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরির, যদি থাকে, সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন।’
নির্বাচন কমিশনের নিরাপত্তাপ্রহরীরাও এসব সুযোগ-সুবিধা চান। তাঁদের দাবি, প্রতিটি জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে অন্তত দুজন করে নিরাপত্তাপ্রহরী রাখা হোক। স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটিগুলোও তাঁদের দিতে হবে। কর্মঘণ্টার বাইরে দায়িত্ব পালন করানো হলে সে জন্য আলাদা ভাতা দিতে হবে।
নিরাপত্তাপ্রহরীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়—এ রকম অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেননি। তবে আমরা বিষয়টি দেখব।’
বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী উন্নয়ন পরিষদের কার্যকরী সভাপতি মো. শাহীনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির শর্তে যা-ই থাকুক, তাঁদের ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, তা ‘অমানবিক’। তিনি আরও বলেন, শ্রম আইন মেনে তাঁদের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেওয়া হোক। আর আট ঘণ্টার বেশি বা ছুটির দিনে দায়িত্ব পালন করলে তাঁদেরও ভাতা দেওয়া উচিত।