শিশুসন্তানদের নিয়ে একই বাসায় এরিকো–ইমরান, আপাতত ‘ভালো’ আছেন
আদালতের নির্দেশে গুলশান-১ নম্বরের একটি ভাড়া বাসায় ১৫ দিনের জন্য দুই সন্তানসহ উঠেছেন এরিকো নাকানো ও ইমরান শরীফ দম্পতি। তাঁরা কেমন আছেন জানতে কথা হয় দুই পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে।
ইমরান শরীফের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তানদের নিয়ে আপাতত ভালোই আছেন এরিকো ও ইমরান দম্পতি।’ অন্যদিকে এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির জানান, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুই সন্তান নিয়ে এরিকো ও ইমরান বুধবার দুপুরে তাঁদের বাসায় পৌঁছান। আদালতের নির্দেশে এরিকো একজন দোভাষী পেয়েছেন। তিনিও গুলশানের ওই বাসায় আছেন। তা ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর ও পুলিশ সদস্যরা পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে ইমরান শরীফ প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, তাঁরা একসঙ্গে আছেন বটে, কিন্তু আছেন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায়। সন্তানদের জিম্মা নিয়ে সমঝোতামূলক কোনো আলাপ-আলোচনাই হয়নি এখনো। টুকটাক যা কথাবার্তা হচ্ছে, সবই সাংসারিক। বাসায় সারাক্ষণ পুলিশ সদস্যরা আছেন।
এতে পারিবারিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ব্যবস্থা বরং ভালো। কারণ, ৩১ আগস্ট এরিকো নাকানোর আইনজীবী আদালতকে বলেছিলেন, এক বাসায় থাকলে পারিবারিক সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশ হাজির থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ ওঠার আশঙ্কা কম। তা ছাড়া তিনি নিজেও একটি শক্তিশালী ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়েছেন। তিনি কোনো অন্যায়ের দায় নিতে চান না।
তবে সন্তানদের নিয়ে এই দম্পতি একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছেন গতকাল। আজ সকালে এরিকো ও ইমরানের মেয়েরা অনলাইনে স্কুলে ক্লাসও করেছে।
এখন পর্যন্ত ইমরানের আশঙ্কা, আদালতের রায় এরিকোর পক্ষে গেলে সন্তানদের নিয়ে তিনি জাপানে চলে যাবেন। আর কখনোই তিনি তাঁর সন্তানদের দেখতে পাবেন না।
এত ভয় পাচ্ছেন কেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমরান শরীফ রয়টার্স ও ওয়াশিংটন পোস্টের দুটি লেখা এই প্রতিবেদককে পাঠান। রয়টার্স ও ওয়াশিংটন পোস্টের দুটি প্রতিবেদনের বিষয়ই এক। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের ২২ আগস্ট, ২০১৯ সংখ্যায় ‘প্যারেন্টাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন বিকামস এ ডিপ্লোমেটিক এমব্যারাসমেন্ট ফর জাপান অ্যাহেড অব জি-৭’ নামে প্রতিবেদনটি ছেপেছিল। যার মূল কথা হলো, অভিভাবকদের সন্তান অপহরণের ঘটনা জি-সেভেন বৈঠকের আগে জাপানকে কূটনৈতিকভাবে বিব্রত করছে।
ওই প্রতিবেদনে একাধিক সাক্ষাৎকার রয়েছে। তাঁদের সবাই ভুক্তভোগী অভিভাবক। জাপানি নাগরিককে বিয়ে করার পর বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং সন্তানকে আর দেখতে পাননি তাঁরা। ওয়াশিংটন পোস্ট ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন ও জাপানি বংশোদ্ভূত ৪০০ সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরানোর দাবিতে ‘ব্রিং অ্যাবডাকটেড চিলড্রেন হোম’ নামে একটি মঞ্চ রয়েছে। এর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ একই ইস্যুতে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে কথা বলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ২৬ জন রাষ্ট্রদূতও জাপানে চিঠি দেন। সবশেষ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অভিযোগ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপানের সাতজন বাবা ও একজন মা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের আইন দুই অভিভাবকের যৌথ জিম্মা প্রথায় বিশ্বাসী নয়। শিশুরা যেন ধারাবাহিকভাবে এক জায়গায় থাকতে পারে, সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া হয় বেশি। শুধু যে বিদেশি নাগরিকেরা ভুগছেন তা-ই নয়, জাপানেও বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানকে দেখতে পারেন না এমন অভিভাবকের সংখ্যা প্রচুর।
এদিকে পুরো পরিস্থিতির দিকে খেয়াল রাখছেন এমন একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, এরিকো ও ইমরানের মধ্যে চরম বিরোধ। নানা ইস্যুতে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। এই ১৫ দিনে তাঁরা সন্তানদের ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন তাঁরা।
২০০৮ সালে জাপানের টোকিওতে এরিকো ও ইমরানের বিয়ে হয়। এরিকো পেশায় চিকিৎসক, ইমরান তড়িৎ প্রকৌশলী। তাঁদের তিন সন্তান রয়েছে। এ বছরের শুরুতে এরিকো বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন। এর মধ্যেই ইমরান তাঁর দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর জাপানের আদালত এরিকোর জিম্মায় সন্তানদের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সন্তানদের ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এরিকো। আবার ইমরানও বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতে সন্তানদের জিম্মা চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন।