রোজ ১৮ কিমি হেঁটে আসা-যাওয়া, আয় ২০০ কি ৩০০ টাকা
৬০ বছর বয়সী আবদুল জব্বারের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে পুরান ঢাকার নয়াবাজার-সংলগ্ন বাবুবাজার উড়াল-সেতুর নিচে। দোকানমালিকের ডাকের অপেক্ষায় থাকেন। ডাক পড়লেই ঠেলাগাড়ি নিয়ে চলে যান দোকানের সামনে। মালামাল উঠিয়ে রওনা হন গন্তব্যে। বেশির ভাগ সময় ঢাকার সড়কে যানজটে আটকা পড়তে হয়। ক্রেতার কাছে মালামাল পৌঁছে দিলে মেলে টাকা। সেই টাকায় চলে আবদুল জব্বারের সংসার।
গরমের দিনে খাঁ খাঁ রোদে পিচঢালা তপ্ত রাস্তায় ঠেলাগাড়ি দিয়ে যখন মালামাল নিয়ে রওনা হন, তখন টপটপ করে শরীর দিয়ে ঝরে ঘাম। গামছা দিয়ে মুছে ফেলেন সেই ঘাম। আবার রওনা হন গন্তব্যের দিকে। যত কষ্টই হোক, ক্রেতার বাসায় মালামাল পৌঁছে দিলে মেলে টাকা। করোনার আগে সেই টাকার পরিমাণ ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।
তবে গেল এক বছরে বদলে গেছে পুরান ঢাকার অন্তত দুই হাজার ঠেলাগাড়িওয়ালার জীবনচিত্র।
দোকানপাট খোলা থাকলে, মালামাল বেচাকেনা হলে, তবে কাজ মেলে ঠেলাগাড়িওয়ালার। করোনায় গেল বছরের ২৫ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন দোকানপাট, শপিং মল বন্ধ ছিল। তখন বড় বিপদে পড়ে যান আবদুল জব্বারসহ পুরান ঢাকার নয়াবাজারের অন্তত দুই হাজার ঠেলাগাড়িওয়ালা।
আবদুল জব্বারের কাজ ছিল না, বেকার জীবনের চরম হতাশা তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। আয়শূন্য জীবনে জব্বারের রাত-দিন কাটত ঘরে। এমনও দিন গেছে, ঘরে তাঁর এক কেজি চাল নেই। টাকাও কাছে নেই। তবু দুই সন্তান আর স্ত্রীর মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে হবে? মানুষের দেওয়া সাহায্যের চাল নিয়ে স্ত্রী-সন্তানের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিয়েছেন। আবদুল জব্বারের ঢাকার ৩৫ বছরের জীবনে এর থেকে কষ্টের দিন কোনো দিন পার করতে হয়নি। ঘরভাড়া দিতে পারেননি তিন মাস। মাস গেলে বাড়িওয়ালা ভাড়া চাইতেন, তখন জব্বারের মুখখানা মলিন হয়ে যেত। আয় নেই, ভাড়া কোত্থেকে দেবেন?
আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন বাবা মারা যান। অভাবের সংসারে হাল ধরেন তাঁর মা। মানুষের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে পাঁচ ভাইকে বড় করে তোলেন মা। তাঁর বয়স যখন ১৫ বছর, তখন মা-ও মারা যান। পরে মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। বিয়ের পর ৩৫ বছর আগে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। সেই থেকে শুরু তাঁর ঢাকার জীবন। প্রথম দিন থেকে তিনি ঠেলাগাড়ি চালান।
রোজ ১৮ কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া-আসা
৩৫ বছর আগে কুমিল্লার দাউদকান্দির রঘুনাথপুর গ্রামে দিনমজুরি করে জব্বারের পকেটে ৪০ টাকাও আসত না। সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। পরে গ্রামের এক মুরব্বির পরামর্শে কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন আবদুল জব্বার। অচেনা ঢাকা শহরে প্রথমে তাঁর ঠাঁই মেলে বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা শ্যামবাজারে। জব্বার সেদিনও শ্যামবাজারে আনমনা বসেছিলেন। তখন একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি ঠেলাগাড়ি চালাতে পারবে?’
জবাবে জব্বার তখন বলেছিলেন, ‘আমি তো ঠেলাগাড়ি চালাতে পারি না।’ তখন সেই ঠেলাগাড়ির চালক জব্বারকে বলেছিলেন, ‘আমি, তোমাকে ঠেলাগাড়ি চালাতে সাহায্য করব।’ সেই থেকে ঠেলাগাড়ি চালানো শুরু জব্বারের। সময়ের ফেরে তরুণ জব্বার আজ বৃদ্ধ। সারা দিন ঠেলাগাড়ি চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়ে পুরান ঢাকায় স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে বসবাস সম্ভব নয়। সে জন্য প্রথম থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় থাকেন।
সময় বদলেছে, শহরের চেহারা বদলেছে কিন্তু বদলায়নি আবদুল জব্বারের ভাগ্যের চাকা। আগেও কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নারায়ণগঞ্জ থেকে নয়াবাজারে চলে আসতে হতো। এখনো আসতে হয়। তবে করোনার আগে কাজ ছিল, পকেটে টাকা ঢুকত রোজ। দেশে করোনা আসার পর নিয়মিত কাজ না থাকায় বড় বিপদে পড়েছেন আবদুল জব্বার। এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রায় প্রতিদিন তাঁকে পুরান ঢাকার নয়াবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় যেতে হয়। বেশির ভাগ দিন রাত ৮টার পর কাজ শেষ হয় তাঁর। এরপর হাঁটা শুরু করেন আবদুল জব্বার। নয়াবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে তিনি যান প্রথমে জুরাইন রেললাইনে। পরে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যান বাড়িতে। প্রতিদিন আসা যাওয়ায় ১৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন তিনি।
আবদুল জব্বার বলছিলেন, ‘আমি তো গরিব মানুষ। কিছুদিন আগেও দোকানপাট বন্ধ ছিল। কাজ ছিল না। আবার দোকানপাট খুলেছে কিন্তু বেচাকেনা কম। বেশির ভাগ দিন কাজ থাকে না। দোকানের সামনে ঠেলাগাড়ির ওপর বসে থাকতে হয়। দিন শেষে যদি ২০০ টাকা হয়, তাহলে কেমনে চলবে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আসতে-যেতে আমার খরচ হয় ১০০ টাকা। আমার যদি যাতায়াতেই রোজ ১০০ টাকা খরচ হয়, তাহলে আমি কেমনে সংসার চালামু। তাই এখন নারায়ণগঞ্জ থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে নয়াবাজারে আসি। আবার রাতে হেঁটে হেঁটে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাই।’
ঘাম ঝরানো এই কষ্ট, এই সংগ্রাম এ কেবল জব্বারের একার নয়। জব্বারের মতো ঢাকা নগরীর লাখ লাখ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের রোজ ঘাম ঝরানোর বিনিময়ে হাতে আসে কিছু টাকা। সেই টাকা পাই টু পাই হিসাব করেই তবে সংসার চালাতে হয় তাঁদের। বেশির ভাগ নগরীর শ্রমজীবী মানুষ তাঁর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় রেখে সংসার চালাতে পারেন না। যা টাকা আয় হয়, তা গ্রামে পাঠিয়ে দেন। নিজে থাকেন অল্প টাকা ভাড়ার কোনো মেসে।
আর যাঁরা কুমিল্লার আবদুল জব্বারের মতো স্ত্রী-সংসার নিয়ে ঢাকায় থাকেন, তাঁদের অনেক হিসাবে করে চলতে হয়। দিনের বেশির ভাগ সময় কাজ করেন পুরান ঢাকায়, অথচ থাকেন নারায়ণগঞ্জে।
কেন তিনি পুরান ঢাকা কিংবা আশপাশের এলাকায় বসবাস করেন না, জানতে চাইলে আবদুল জব্বার হেসে বলেন, ‘ক্যামনে থাকমু। ভালো সময়ে আমার আয় তো বড় জোর ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। পুরান ঢাকায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার নিচে কি কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে? যাবে না। কেরানীগঞ্জ কিংবা কামরাঙ্গীরচরেও ৫/৭ হাজার টাকার নিচে বাসা-ভাড়া পাওয়া যায় না। তাই আমি থাকি সেই কম টাকার ভাড়ায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। মাসে ভাড়া দিই ৩ হাজার টাকা। আমার পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে থাকে দুজন। ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, মেয়ে পড়ে স্কুলে।’
কিছুদিন আগেও করোনায় কঠোর লকডাউনে যখন সব দোকানপাট বন্ধ ছিল, তখন জব্বার কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। গেল বছরেও জব্বার মিয়া একটি টাকাও সরকারি সহায়তা পাননি। এ বছরও পাননি কোনো সরকারি সহযোগিতা।
কঠোর পরিশ্রম করে দিন কাটিয়েছেন। কোনো সঞ্চয় নেই তাঁর। এক ছেলে আর এক মেয়েকে বড় করে তোলাটাই এখন তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ঠেলাগাড়ি চালিয়ে সংসার চালাবেন জব্বার। কারও কাছে হাত পাতবেন না।
আবদুল জব্বার বললেন, ‘আমরা শ্রমিক মানুষ। এই বয়সে যখন কয়েক মণ চাল ঠেলাগাড়িতে নিয়ে রাস্তায় যাই, যানজটে আটকে থাকি, তখন অনেক কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। তবু আমাকে গাড়ি টানতে হয়। মালামাল লোকের বাসায় পৌঁছে দিতে হয়। এই কষ্টই আমার জীবন। আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না।’