রোজিনাকে হেনস্তা: সরকারের কাছে তথ্য চায় জাতিসংঘের ৫ দূত
প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কোন প্রেক্ষাপটে ও কী অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, তাঁর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি না—এসব বিষয়ে জানতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক পাঁচজন বিশেষ দূত বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ নিযুক্ত বিশেষ ওই দূতেরা গত ২৮ জুন বাংলাদেশ সরকারকে যৌথ চিঠি পাঠান।
জাতিসংঘের পাঁচ বিশেষ দূত লিখেছেন, তাঁদের ওপর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ অর্পিত দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লিখে পরের দুই মাসের মধ্য এর জবাব দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। রোজিনা ইসলামের প্রসঙ্গটি তাঁরা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে অবহিত করবেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন।
তবে এখন পর্যন্ত ওই চিঠির জবাব পাননি জাতিসংঘের পাঁচ বিশেষ দূত।
সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ ৫ দূত মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষা ও উৎসাহিতকরণবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান, আরবিট্রারি ডিটেনশনবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের ভাইস চেয়ার মিরিয়াম অ্যাস্ট্রাদা-কাসতিল্লো, মানবাধিকারের ‘ডিফেন্ডারদের’ পরিস্থিতিবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার মেরি ললর, নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তিবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার নিলস মেলজার এবং নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ডুবরাভকরা সিমোনাভিচ।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গত ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখা, পরে থানায় নিয়ে যাওয়া, আদালতে তোলা, রিমান্ড আবেদন, কারাগারে পাঠানো, পাসপোর্ট জমা রাখা, দেশ না ছাড়ার শর্তে ২৩ মে জামিন মঞ্জুর হওয়া ও কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার তথ্যগুলো জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা আমলে নিয়েছেন।
রোজিনা ইসলামকে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থা ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড ‘ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড-২০২১’ দিয়েছে। তিনি পুরস্কারটি পেয়েছেন সেরা অদম্য সাংবাদিক বা মোস্ট রেজিলিয়েন্ট জার্নালিস্ট শ্রেণিতে। মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করা সাংবাদিকদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়। গত বছর একই পুরস্কার পেয়েছিলেন এ বছর শান্তিতে নোবেল পাওয়া ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা।
জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা বাংলাদেশ সরকারকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁকে আটকের ঘটনা ঘটে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে তাঁকে আটক ও বিচারের মুখোমুখি করার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা লিখেছেন, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দৃশ্যত কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকার বিষয়ে প্রশ্ন তোলার প্রসঙ্গটি মতপ্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তারে তাঁরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করায় তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে, যা আরও উদ্বেগের। তাঁরা ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন। ওই আইনটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক বিশদ-অস্পষ্ট আইন এবং শাস্তিও কঠোর।
জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা মহামারির সময় জনস্বাস্থ্যবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পটভূমিতে নিরাপত্তা–সম্পর্কিত আইনের প্রয়োগ নিয়েও গভীর উদ্বেগ জানান। তাঁরা লিখেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এই আইন প্রয়োগের প্রভাব অত্যন্ত বিরূপ।
সাংবাদিকতার কারণে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এমন অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে তা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)’-এর ৯ ও ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা।
বাংলাদেশ ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ওই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন করে। ওই অনুচ্ছেদগুলোয় তথ্য চাওয়া, পাওয়া, প্রকাশসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯তম অনুচ্ছেদে চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, জনস্বার্থে তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতাসহ ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন থাকার বিষয়টিও আমলে নিয়েছেন।
জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সুরক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর গ্রেপ্তারের ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছেন।
রোজিনা ইসলামকে আটক-গ্রেপ্তারের বিষয়ের ঘটনাক্রম, আইনি তথ্য, আইসিসিপিআরের ১৯তম অনুচ্ছেদের সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার ও মামলার সামঞ্জস্য বিষয়েও জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
তথ্য অধিকার আইনে জনস্বার্থ–সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতার আলোকে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ প্রয়োগের বিষয়ে সরকারের ভাবনাও জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরা।