মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে যেসব কারণে
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৬৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭৫৮ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর একই সময়ে ১ হাজার ১১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ২৬ জন। এ হিসাবে গত ১০ মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৭১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। আজ বুধবার প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি আকারে পাঠানো হয়। ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অল্প বয়সীরা বেশি মারা যাচ্ছেন উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর এ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ হাজার ৩২৭ (৭৫ শতাংশ)। এর মধ্যে ৬৬৯ জন শিক্ষার্থী ও ৭২ জন শিক্ষক। মোটরসাইকেলের ধাক্কায় মারা গেছেন ১৫১ পথচারী।
এ দুর্ঘটনার ধরন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৩৪৯টি (২১.১১ শতাংশ), মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ৫৮৩টি (৩৫.২৬ শতাংশ), মোটরসাইকেলকে অন্য যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ৭১৫টি (৪৩.২৫ শতাংশ) এবং অন্যান্য কারণে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা ছয়টি (০.৩৬ শতাংশ)।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ১২টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর অন্যতম কিশোর-যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো, অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতা, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা, পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণ প্রশ্রয় দেওয়া, রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সংস্কৃতি।
পাশাপাশি ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতাকেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দিন ও রাতের সময় বিশ্লেষণ করে ফাউন্ডেশনের হিসাবে বলা হয়, মোটরসাইকেলে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে বিকেলে (২৬.৩৭ শতাংশ)। এ ছাড়া সকালে ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, দুপুরে ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও রাতে ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। কম দুর্ঘটনা ঘটে ভোরে, ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত ১০ মাসে ২ হাজার ৭৪৯টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ১ হাজার ৭১৯টি, বাস ১৯৪টি, ট্রাক ৪৮১টি, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক্টর, ট্রলি, লরি ১৭২টি, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার ৫৬টি, থ্রি হুইলার (ইজিবাইক, অটোরিকশা, অটোভ্যান, নছিমন, ভটভটি, টমটম) ১১৩টি এবং প্যাডেল রিকশা ও বাইসাইকেল ১৪টি।
দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬৭২টি (৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ) দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলচালক এককভাবে দায়ী। বাসচালক দায়ী ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ (১৭৮টি দুর্ঘটনা), ট্রাকচালক ২৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ (৪৪৩টি দুর্ঘটনা), কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক্টর, ট্রলি, লরিচালক ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ (১৫৮টি দুর্ঘটনা), প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসচালক ২ দশমিক ৭২ শতাংশ (৪৫টি দুর্ঘটনা), থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক, অটোরিকশা, অটোভ্যান, নছিমন, ভটভটি ও টমটম) চালক ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ (৯৬টি দুর্ঘটনা), প্যাডেল রিকশা ও বাইসাইকেলচালক শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ (৯টি দুর্ঘটনা) ও পথচারী দায়ী ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ (৫২টি দুর্ঘটনা)।
দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দেশের সর্বত্র কিশোর-যুবকদের হাতে বেশি গতির মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। এগুলো ক্রয় ও ব্যবহারে নিয়মকানুন মানার বালাই নেই; নেই মনিটরিং ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ মোটরসাইকেল চলছে। শুধু রাজধানীতে চলছে ১২ লাখের বেশি। মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব ও যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এ জন্য গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে।
সাইদুর রহমান বলেন, গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত না করে মোটরসাইকেল উৎপাদন উৎসাহিত করা সরকারের একটি আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত, এখনই মোটরসাইকেল উৎপাদন, ক্রয় ও ব্যবহারে লাগাম টেনে একটি টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ১৩টি সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এগুলোর অন্যতম কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া; মাত্রাতিরিক্ত গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা; মহাসড়কে মোটরসাইকেলের আলাদা লেন তৈরি, গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। এ ছাড়া দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, গণপরিবহনের চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।