মৃত্যুর ঘোর থেকে জীবনের পথে
স্কুলের শ্রেণিকক্ষে বসেই দুঃসংবাদটি পেয়েছিল সাকিব। সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবনটা ধসে পড়েছে। সেটা ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। বাড্ডা বাটপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত তখন। বয়স ৯-১০। রানা প্লাজা ভেঙে পড়েছে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ আর আলোচনা চলছিল। অনেকে মারা গেছেন, এমন আলাপও হচ্ছিল। হঠাৎ সাকিবের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। তার আম্মু আর আপুও যে কাজ করে রানা প্লাজারই একটি পোশাক কারখানায়!
ঘোরের মধ্যে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ক্লাস থেকে। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করেছিল রানা প্লাজার দিকে। যেতে যেতে পথে দেখল মানুষের ভিড়। রক্ত-কাদায় মাখামাখি আহত লোকজনকেও দেখতে পেল। কাউকে ধরাধরি করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে ছুটছেন অন্য মানুষজন। কেউবা নিজেরাই ছুটে এসে পথে পড়ে কাতরাচ্ছেন। কোনো দিকে তাকানোর সময় ছিল না তখন সাকিবের। সে কাঁদছিল আর পাগলের মতো ছুটছিল।
রানা প্লাজার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হলো না। সেখানে ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাজার হাজার মানুষের ভিড় আর আহাজারি। মাইকে যেন কী সব বলছে কারা। কিছুই মাথায় ঢুকছিল না সাকিবের। কাছাকাছি একটা উড়ালসড়কে গিয়ে উঠল। সেখানেও মানুষে মানুষে সয়লাব। সেই ভিড়ের ভেতর থেকে দেখল, ২০ গজের মতো দূরত্বে দাঁড়ানো রানা প্লাজার ৯ তলা ভবনটি দেবে গিয়ে ২ তলার মতো হয়ে গেছে। আম্মু আর আপু যে সেই ভেঙে দেবে যাওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়েছে, সেটা বুঝতে বাকি ছিল না। তবু মন মানে না। সামান্য একটু আশা নিয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল এখানে ওখানে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে শুনতে পেল আপুকে পাওয়া গেছে আহত অবস্থায়। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়েছে। ‘আল্লাহ্ চাইলে কত কিছু হয়। এবার আম্মুকেও যদি পাওয়া যায়...।’ সাকিবের খোঁজ আর শেষ হয় না। কখনো সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে, কখনো আশপাশের হাসপাতালে, মর্গে। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, সময়-অসময় নেই, শুধু খোঁজ আর খোঁজ। একদিন তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। আশপাশের লোকজন পানি খাইয়ে, সুস্থ করে তারপর তার বাবাকে ফোন করেছিল।
অবশেষে পাওয়া গেল ১৭ দিন পর। কিন্তু চেনার কোনো উপায় নেই। অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে অনেক লাশের ভিড়ে হাতের চুড়ি গলার মালা, কানের দুল দেখে শনাক্ত করতে পারল আম্মুকে।
রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনায় অনেক পোশাকশ্রমিকের সন্তানের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা হয়তো সাকিব মুন্সির (১৭) মতোই। কিন্তু মায়ের স্নেহবঞ্চিত ধু ধু মরুভূমির মতো জীবনে মাথার ওপর যে মমতা ও নির্ভরতার ছায়া পরে সাকিব পেয়েছিল, সেটা সবার ভাগ্যে জোটেনি, সচরাচর জোটে না।
অরকা হোমসের আশ্রয়
হয়তো ভাগ্যবিড়ম্বিত এই শিশুগুলোর কথা আজ আমরা জানতেই পারতাম না। পোশাকশ্রমিক মা নিজের ক্ষুদ্র উপার্জনের সামর্থ্যে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর যে সাহস করেছিলেন, সেই মা না থাকলে কে নেবে এই ভার? হয়তো পথেঘাটে ঘুরে এ পেশা-সে পেশা বদল করে দুবেলার খাওয়ার সংস্থান করতে গিয়ে পথেই হারিয়ে যেত এসব শিশুর সম্ভাবনা। কিন্তু রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর অন্তত অর্ধশতাধিক ছেলেমেয়ের জীবনে সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে ‘অরকা’—ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অ্যাসোসিয়েশন।
চট্টগ্রাম ও গাইবান্ধায় এই অ্যাসোসিয়েশনের দুটি এতিমখানা আছে ‘অরকা হোমস’ নামে। অবশ্য প্রচলিত অর্থে এতিমখানা বলতে যা বোঝায়, এ দুটি শিশু নিকেতনকে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ডে এখানে শিশুদের গড়ে তোলা হচ্ছে।
অরকা হোমসের চট্টগ্রাম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০১ সালে। পতেঙ্গার ডেলপাড়া এলাকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১০ কাঠার মতো জায়গার ওপর ইটের দেয়ালের গাঁথুনি আর টিনের ছাউনি দেওয়া ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির এই বাড়িটিতে ৩০ জন শিশুর থাকার ব্যবস্থা। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বিজিএমইএর মধ্যস্থতায় এখানে আশ্রয় পেয়েছিল ১০টি শিশু। অন্য শিশুদের সঙ্গে এখনো এখানে আছে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো ৭টি শিশু।
গাইবান্ধার অরকা হোমসটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। বড় জায়গার সংকুলান করা গেছে বলে এখানে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে অনেক বড় পরিসরে। এক একরের চেয়ে বেশি জমির ওপর গড়ে উঠেছে এখানকার শিশু নিকেতন। তিনটি সুদৃশ্য ভবন। ছেলে ও মেয়েদের থাকার জন্য আছে দুটি পৃথক তিনতলা ভবন। এ ছাড়া একটি চারতলা স্কুলভবন, একটি হাসপাতাল, খেলার মাঠ, গাছ-গাছালি নিয়ে এক মনোরম ক্যাম্পাস। মোট ৬০ জন ছাত্রছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা এই কেন্দ্রে। তার মধ্যে বিজিএমইএর আংশিক পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে থাকার সুযোগ পেয়েছে রানা প্লাজারই নিহত-আহত শ্রমিকের ৫৩ জন সন্তান।
জীবনের পথে
কেউ ১৭ দিন পর পেয়েছে মায়ের লাশ, কেউ বাবাকে হারিয়েছে, কেউ ফিরে পেয়েছে অর্ধমৃত বা পঙ্গু মা ও বোনকে, কেউবা আবার লাশটাও পায়নি। এই বিভীষিকা ও দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে ছোট শিশুদের মুক্ত করে আনাটাই ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই কাজটিই করতে হয়েছে অরকা হোমসের উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষক ও শিক্ষকমণ্ডলী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব মানুষকে। আজ এই শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ততা, লেখাপড়ায় মনোযোগ বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ দেখে মনে হয়, সেই কাজে তারা অনেকটাই সফল। দিনের পর দিন মা-বাবার জন্য অশ্রুপাত করেছে এই শিশুরা, অনেক রাত কাটিয়েছে নির্ঘুম। কিন্তু মায়া-মমতা দিয়ে, সর্বোপরি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে ওদের নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে অরকা হোমস।
মনে পড়ে ২০১৭ সালে অরকা হোমসের চট্টগ্রাম কেন্দ্রে গিয়ে কথা বলেছিলাম নয়ন ও কিরন নামের দুই ভাইয়ের সঙ্গে। বড় ভাই নয়ন (আতিকুল ইসলাম) আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিল একটি রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে...।’ মুগ্ধ হয়েছিলাম সেদিন তার গান শুনে। এত বছর পর গত ১৭ এপ্রিল (২০২১) হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথা বললাম গাইবান্ধার অরকা হোমসে আশ্রিত নবম শ্রেণির ছাত্রী সাগরিকা আকতারের (মিম) সঙ্গে। মিম আমাদের যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত করে চমৎকার ইংরেজি উচ্চারণে আবৃত্তি করল হুইটম্যানের কবিতা ‘ও ক্যাপ্টেন মাই ক্যাপ্টেন’।
কতটা ট্রমা কাটিয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে, সেটা বোঝানোর জন্য এই দুটি শিশুর দুঃসহ অতীতটা পাঠককে একটু জানাতে চাই। নয়নের মাকে উদ্ধার করা হয়েছিল ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিতাবস্থায়। কিন্তু হাত-পা ও মেরুদণ্ড ভাঙা সেই মা আর কোনো দিন সোজা হয়ে হাঁটতে চলতে পারেননি। আর মিমের মাকে তো জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায়ই উদ্ধার করা যায়নি। শুধু ডিএনএ টেস্ট করে মিমের সঙ্গে রক্ত মিলিয়ে একটি অবয়বহীন শরীরের কিছু অংশকে শনাক্ত করা হয়েছিল তার মায়ের লাশ হিসেবে। এখানকার প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জীবনেই আছে এ রকম অতীতের গল্প। কিন্তু সেসব ভুলে সামনে এগোতে চায় তারা।
স্বপ্ন ও সম্ভাবনা
অরকা হোমসে সাধারণত এসএসসি পর্যন্ত শিশুদের রাখা হয়। তারপরও যদি কেউ মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, তার জন্য আরও সাহায্য-সহযোগিতা করতে অরকা প্রস্তুত বলে জানালেন অরকা সেন্ট্রাল কমিটির আহ্বায়ক ক্যাপ্টেন (অব.) জাহানইয়ার। এ ছাড়াও যারা এসএসসি বা এইচএসসি শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চায়, তাদের বাংলাদেশ নৌবাহিনী টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ছয় মাসের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অরকা হোমসে যারা এসেছিল, তাদের বেশির ভাগেরই কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বয়স এখনো হয়নি। এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা সম্পন্ন করে সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে গেছেন রিমন হাসান নামের একজন। এইচএসসি পাস করে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হয়েছেন দুজন। এর আগে মেহেদী হাসান (শাওন) নামের একজন এসএসসি পাস করে রংপুর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুলে (ম্যাটস) ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু মেহেদীর বাবা রানা প্লাজার ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার মায়ের পক্ষে আর চাকরি করা ও একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলে শাওন ইন্টার্নশিপ শেষ করতে পারল না। তার আগেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের কর্মচারী হিসেবে কাজ নিয়েছে। নয়ন নামের যে ছেলেটির গান শুনেছিলাম ২০১৭ সালে, সে এইচএসসি পাস করে এখন তিতুমীর কলেজে সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্নাতক শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা আছে তার। ছোট ভাই কিরন এখন গাইবান্ধায় আছে অরকা হোমসে। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে।
শুরুতেই মায়ের সন্ধানে রানা প্লাজার দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকা শিশু সাকিবের গল্প বলেছিলাম। মাতৃহীন সাকিব আর তার ছোট ভাই সজীব অরকা হোমসে আশ্রয় পেয়েছিল তখনই। এত দিন পর সবচেয়ে ছোট ভাই সবুজকেও তারা নিয়ে আসতে পেরেছে নিজেদের কাছে। তিন ভাই এখন যথাক্রমে দশম, ষষ্ঠ ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। সাকিব মুন্সি লেখাপড়া শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ভবিষ্যতে ছোট দুটি ভাইকেও অনেক বড় মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে চায় সে।
সমাজ পাবে প্রতিদান
‘এই ছেলেমেয়েগুলো যদি জীবনে সাফল্য পায়, প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলেই সার্থক হবে আমাদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ,’ বললেন ক্যাপ্টেন (অব.) জাহানইয়ার। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই শিশুদের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের বাবদ ‘অরকা’র গাইবান্ধা শাখার জন্য এক লাখ ও চট্টগ্রাম শাখার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা মাসিক বরাদ্দ দেয়। এ টাকা যথেষ্ট কি না, সে প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য না করে অরকার আহ্বায়ক বললেন, ‘সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে এই শিশুরা একদিন সমাজকে তার প্রতিদান দেবে—এটাই আমার বিশ্বাস।’
এই ছেলেমেয়েগুলো যদি জীবনে সাফল্য পায়, প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলেই সার্থক হবে আমাদের স্বপ্ন ও উদ্যোগক্যাপ্টেন (অব.) জাহানইয়ার
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক। আহত হয়েছিলেন দুই হাজারের বেশি। হতাহতদের সবার সন্তানের খোঁজ আমরা রাখতে পারিনি। কিন্তু এই যে অর্ধশতাধিক শিশু একটা আশ্রয় পেল, শিক্ষার সুযোগ পেল, তারা যদি একদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেটা হবে দেশ ও জাতির জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি।