ভিসির মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতেই নীতিমালা বদল

শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। এর মাধ্যমে কম যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এ রকমভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের নীতিমালা অনুযায়ী যাঁদের আবেদনের যোগ্যতা ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ রকম আরও কিছু অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ জন্য উপাচার্যকে দায়ী করে কমিটি বলেছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড উপাচার্যের মতো সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এ কারণে উপাচার্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছ কমিটি। তারা বলেছে উপাচার্যের নৈতিকতা বিবর্জিত এই ধরনের কর্মকাণ্ড জরুরি ভিত্তিতে বন্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যাতে প্রাচীন ও এতিহ্যবাহী এই উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও গবেষণার সার্বিক পরিবেশের উন্নয় সাধিত হয়।  এ ছাড়া নীতিমালা পরিবর্তনের সুযোগে নিয়োগ পাওয়া ৩৪ জনের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। উপাচার্য পদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। শিথিলের সুযোগে নিয়োগ পাওয়া ৩৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলে নির্দেশের সুপারিশ


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রতিবেদন দিয়েছে ইউজিসি।
প্রতিবেদন জমার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও ইউজিসির সদস্য দিল আফরোজা বেগম। তবে এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাননি তিনি।
গণশুনানিসহ বিভিন্নভাবে তদন্তকাজটি করেন ইউজিসির দুই সদস্য। তবে উপাচার্য গণশুনানিতে হাজির হননি, বরং ইউজিসি চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে উপাচার্য তাঁর বিরুদ্ধে ইউজিসির তদন্ত কমিটি গঠনের এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমার পর বক্তব্য জানতে গতকাল বুধবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল ধরেননি।  

আবদুস সোবহান ২০১৭ সালের মে থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রথম মেয়াদেও (২০০৯-২০১৩) তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। মাঝে এক মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন।
উপাচার্য আবদুস সোবহান ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমান। আগের নীতিমালায় আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি বা গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ-৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ-৩.৫০। এ ছাড়া স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রম প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। পরিবর্তিত নীতিমালায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ মোটাদাগে ৩.২৫-এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্তও তুলে দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনটি এখনো হাতে আসেনি। পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মহিবুল হাসান চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী


তদন্ত কমিটি বলেছে, নীতিমালা পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে চলা চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা এখন সর্বনিম্ন। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় যোগ্যতা কমিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করা ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন উপাচার্য।
তদন্ত কমিটি বলেছে, যোগ্যতা কমানোর একটাই উদ্দেশ্য, ২০১৭ সালের আগে যাঁদের আবেদন করার যোগ্যতা ছিল না, তাঁদের নিয়োগের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে।
এই সুযোগেই মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা উপাচার্যের কন্যা সানজানা সোবহান নিয়োগ পান টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে এবং জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ নিয়োগ পান ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। আগের নীতিমালা অনুযায়ী তাঁদের আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। কারণ বিভাগে উপাচার্যকন্যার মেধাক্রম ছিল ২১ তম, আর জামাতার এমবিএ পরীক্ষায় মেধাক্রম ছিল ৬৭ তম এবং তাঁর ফল ছিল সিজিপিএ-৩.৪৭। অথচ অন্য আবেদনকারীদের অধিকাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি ছিল। এ ছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠিত টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সাধারণত প্রথমে টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয় থেকে পাস করা প্রার্থী নেওয়ার কথা। কিন্তু সেটি না করে মার্কেটিং ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে উপাচার্য কন্যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

উপাচার্য তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, নিয়োগ বোর্ড এই নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটি দেখেছে, বোর্ডে পাঠদানের দক্ষতা যাচাই হয়েছে— এমন কোনো দালিলিক প্রমাণও নেই। এমন নিয়োগে বোর্ডেরও দোষ দেখেছে কমিটি।
আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগেও নিয়মের ব্যত্যয় দেখেছে তদন্ত কমিটি। অনুষদে প্রথম হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পাওয়া, এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি থাকা আবেদনকারীকে বাদ দিয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন পরে সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মেয়েকে বিয়ে করেন। তদন্ত কমিটির মূল্যায়ন ‘লক্ষ্য করেই’ এটি করা হয়েছে।
উপাচার্যের বাসভবনে ওঠার পরও আগের বরাদ্দ করা বাড়িটি কাগজপত্রে ছেড়ে দিলেও আসবাব রাখার জন্য প্রায় দেড় বছর নিজের দখলে রেখেছিলেন উপাচার্য। এরও সত্যতা পেয়েছে কমিটি।
তবে বিচারাধীন থাকায় উপাচার্যের নিজ বিভাগ থেকে অবসর এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ঠিকভাবে না জানানোর বিষয়ে তদন্ত কমিটি কিছু বলেনি।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনটি এখনো হাতে আসেনি। পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।