ভাটার জীবনে ভালোবাসার জোয়ার
ছেলের উচ্চতা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি। মেয়ের ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। ছেলে দেখতে ফরসা। মেয়ে কালো। কিন্তু মনের তো কোনো আকার নেই। রং নেই। তবে ভালোবাসার রঙে মন যখন রঙিন হয়, তখন বাহ্য কি আর গ্রাহ্যে আসে!
তবে পরিবার, সমাজকে এই রং সব সময় সমানভাবে রাঙাতে পারে না। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। গাইবান্ধার সদর উপজেলার ধোপাডাঙ্গা গ্রামে মনিরুল ইসলাম (৩২) রাজশাহীর পবা উপজেলার বজরাপুর গ্রামের মাসুরা খাতুনকে (২৭) বিয়ে করলেন মেয়ের পরিবারের অমতে।
মনিরুল জানান, ১০ বছর আগের কথা। ইটভাটায় কাজ করতে রাজশাহীর পবায় আসেন তিনি। ইটভাটার পাশেই ছিল খর্বাকৃতির মাসুরার বাড়ি। সে তখন ইটভাটায় যাওয়া-আসা করতেন। একসময় মাসুরার প্রতি তাঁর মনে অদ্ভুত এক মায়া জন্ম নেয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একদিন তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। বিয়েতে ছেলের পরিবারের আপত্তি না থাকলেও বাদ সাধে মেয়ের পরিবার। তাদের মনে ভয় ছিল, বিয়ে করে ছেলে কয়েক দিন পরে মাসুরাকে ফেলে না চলে যায়।
মনিরুল ও মাসুরা শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে বিয়ে করেন। মনিরুল জানান, এরপর তাঁরা মাসুরার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। একদিন মাসুরার পরিবারের লোকজন তাঁদের ওপর হামলারও চেষ্টা করেছিল। রাতে তাঁদের শয়নকক্ষের জানালা ভেঙে এ হামলার চেষ্টা করে।
তবে মনিরুল-মাসুরার ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত সব বাধাকে জয় করেছে। এক বছর, দুই বছর দেখতে দেখতে আট বছর পার হয়ে যায়। মেনে নেয় মাসুরার পরিবারও। একখণ্ড জমি দেওয়া হয় মনিরুলকে। সেখানে ইটের একটা ছোট্ট ঘর করে এখন বসবাস করছেন এই দম্পতি।
এরপরই মনিরুল-মাসুরার সংসারের সুখ-তরির পালে অন্য রকম হাওয়া লাগল। মা হবেন মাসুরা। খুশির সঙ্গে উৎকণ্ঠাও তো কম ছিল না। মায়ের ওজন যে মাত্র ১২ কেজি!
ভালোবাসার শক্তিই যেন ভিন্ন রকম। গত বছর ২ জুন মাসুরাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৯ জুন বেলা ১১টায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন মাসুরা।
জানতে চাইলে মাসুরার চিকিৎসক নূর-এ-আতিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গর্ভধারণের সময় মেয়েটির ওজন ছিল মাত্র ১২ কেজি। বাচ্চা প্রসবের সময় ওজন বেড়ে হয় ২২ কেজি। বাচ্চার ওজন ছিল সোয়া দুই কেজি। তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু একটা বিরল ঘটনা, সে জন্য বিভাগীয় প্রধান হাসিনা আক্তার নিজে মাসুরার অস্ত্রোপচার করেন। বাচ্চা হওয়ার পরও তাঁরা চেক-আপ করাতে এসেছিলেন। তাঁরা ভালো আছেন।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান বলেন, তিনি অনলাইন ঘেঁটে দেখেছেন, বাংলাদেশে এত কম ওজনের কোনো প্রসূতির সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনা নেই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এর আগে এ রকম একটা মেয়ের বাচ্চা হয়েছিল। তাঁর ওজন ছিল ৩৭ কেজি। উচ্চতাও ছিল প্রায় সাড়ে তিন ফুট।
সাইদুর রহমান জানান, আমেরিকায় ২ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার একটি মেয়ে গর্ভধারণের খবর তাঁর জানা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘটু গ্রামের একটি ইটভাটায় গত বুধবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মনিরুলের কথা হয়। মনিরুল বললেন, মেয়ে হওয়ায় তাঁর পরিবারের সবাই খুশি। তিনিও খুশি। তিনি বলেন, তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কেউ-ই লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তাই মেয়েটিকে লেখাপড়া শেখাবেন তাঁরা।
মাস খানেক আগে এই ইটভাটায় কাজ শুরু করেছেন মনিরুল। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে এই ইটখোলার অস্থায়ী একটি ঘরে বসবাস করছেন তাঁরা। মেয়ের বয়স এখন প্রায় আট মাস। মুখে ‘দাদা’ বোল এসেছে। শিশুটির জন্য এই পরিবেশটা বেশ বৈরী। কিন্তু কাঁচা-পোড়া ইটের মাঝে হাসি-আনন্দেই কাটছে মনিরুল-মাসুরার জীবন।