ই-কমার্সের নামে সাধারণ গ্রাহকের আরও ৪৮৩ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার তথ্য জানাল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা বলছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ও এসপিসি ওয়ার্ল্ড গ্রাহকের প্রায় ২৩৩ কোটি টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে। আর কিউকম সরিয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।
সিআইডি অর্থ পাচারের অভিযোগে গত রোববার ই-অরেঞ্জ ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলা করেছে। মামলার পর একই দিন রাজধানীর বেইলী রোড থেকে এসপিসি ওয়ার্ল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আল আমিন এবং তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শারমীন আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে কিউকমের সিইও রিপন মিয়াকে গত রোববার রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার পল্টন থানায় গত রোববার রাতে মামলা হয়েছে। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এ মামলা হয়। এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাও যুক্ত করা হয়েছে।
রিপন মিয়াকে গতকাল সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড পেয়েছে ডিবি।
এ নিয়ে ছয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিককালে মামলা হলো। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, নিরাপদডটকম, কিউকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ড। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের পাওনা না দেওয়া এবং কয়েকটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, পাওনা না দেওয়া ও অর্থ পাচার মিলিয়ে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো জানতে পেরেছে, এই ৬টিসহ মোট ১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। সিআইডি অন্তত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে।
প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেল ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন এখন কারাগারে। ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান এবং প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহও এখন জেলে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে সে দেশের কারাগারে রয়েছেন ই-অরেঞ্জের মূল মালিক বলে পরিচিত পুলিশের পরিদর্শক সোহেল রানা। ধামাকা শপিংয়ের সিওও সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিনজন কর্মকর্তা এখন জেলে।
২৩৩ কোটি টাকা ‘সরানোর’ তথ্য
নতুন করে তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের খবর জানাতে গতকাল আলাদা দুটি সংবাদ সম্মেলন করে সিআইডি ও ডিবি। ঢাকার শান্তিনগরে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাঁরা প্রাথমিক তদন্ত শেষে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ২৩২ কোটি টাকা অন্য ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে। এরপর গত রোববার গুলশান থানায় অর্থ পাচার আইনে মামলা হয়।
সিআইডি জানায়, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলাটি হয়েছে ঢাকার কলাবাগান থানায়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া এসপিসি ওয়ার্ল্ডের সিইও আল আমিন ডেসটিনিতে কাজ করতেন। তাঁকে অবৈধভাবে অনলাইনে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) ব্যবসা ও ই-কর্মাস ব্যবসা করে অর্থ আত্মাসাৎ করার অভিযোগে ২০২০ সালে ডিবি গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে তখন তিনটি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ২৬৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
হুমায়ুন কবির আরও জানান, এসব মামলায় দুই মাসের মধ্যে আদালত থেকে জামিন পান আল আমিন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার তিনি একই ব্যবসা শুরু করেন। এ দফায় সিআইডির হাতে গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
২৫০ কোটি টাকা ‘সরিয়েছে’ কিউকম
ঢাকার মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ডিবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিউকমের সিইও রিপন মিয়া তাদের কাছে দাবি করেছেন, এই মুহূর্ত কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকা অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থা বা পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে। তবে এর বাইরেও কিউকম ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে রিপন স্বীকার করেছেন।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা থেকে কিউকমের গ্রাহকেরা নিজেদের কিছু পাওনা ফেরত পেতে পারেন।
কিউকমের সিইও গ্রেপ্তারের পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এতে বলা হয়, কিউকমের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করেছেন সৌরভ দে নামের একজন গ্রাহক। কিউকমে তাঁর পাওনার পরিমাণ ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
ডিবির হাফিজ আক্তার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুন মাসে ‘এসক্রো’ ব্যবস্থা চালু করে। যে ব্যবস্থায় গ্রাহকেরা পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা ছাড় হয়। পেমেন্ট গেটওয়েতে লেনদেনে কোনো অস্বচ্ছতা থাকলেও সেসব বিষয়েও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে সিআইডি।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিউকমের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি দেয় গত ২৭ সেপ্টেম্বর। এতে বলা হয়, কিউকম দাবি করছে, পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে তাঁদের ৪২০ কোটি টাকার বেশি আটকে আছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
কিউকমের গ্রাহকেরা এখন তাঁদের পাওনা ফেরতের অপেক্ষায়। গ্রাহকদের একজন আবদুল্লাহ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে গ্রাহকের পাওয়া মূল টাকা ফেরতের একটি উদ্যোগ নিতে পারে। বহু মানুষ খুব কষ্টে আছে। ওদিকে টাকাগুলো পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে।