‘বিনা নিড়ানি’পদ্ধতি পাবনার চাটমোহরের কৃষকদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। যে পাট চাষ করে তাঁরা এত দিন লোকসান গুনেছেন, তা এবার তাঁদের লাভের মুখ দেখিয়েছে। সারা দেশে পাটের আবাদ কমলেও চাটমোহরে পাটের আবাদ বাড়ছে।
পাট আবাদে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে ‘বিনা নিড়ানি’পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় কৃষকের উৎপাদন খরচ কমেছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। গত এক বছরেই এখানকার কৃষকদের মধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। সার ব্যবহারের সময় ও পরিমাণে পরিবর্তন এনেই এই সফলতা পাওয়া গেছে।
পাট চাষের এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন চাটমোহর উপজেলা কৃষি বিভাগের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল খালেক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও এই পদ্ধতিটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে ও নিজের চিন্তা প্রয়োগ করে খালেক এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন।
পাট আবাদের সনাতন পদ্ধতি: পাটচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতি বিঘা জমিতে প্রয়োজনমতো চাষ দিয়ে সাড়ে সাত কেজি ইউরিয়া, ১২ কেজি টিএসপি ও পাঁচ কেজি পটাশ সার দিয়ে বীজ বপন করতে হয়। এতে চাষ ও সার বাবদ খরচ হয় প্রায় ৮০০ টাকা। এরপর চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন জমির আগাছা পরিষ্কার করতে একবার নিড়ানি দিয়ে আবার ১০ কেজি ইউরিয়া দিতে হয়। এতে আট থেকে ১০ জন শ্রমিক ও ইউরিয়া বাবদ খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। পাটের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ দিন হওয়ার পর আবার দ্বিতীয় দফা নিড়ানি ও সাত থেকে আট কেজি ইউরিয়া সার দিতে হয়। এ সময় পাঁচ থেকে সাতজন শ্রমিক ও ইউরিয়া বাবদ খরচ হয় প্রায় দুই হাজার টাকা। পাটের দুই মাস বয়সে আবার দুই থেকে তিনজন শ্রমিক দিয়ে বাছাই করে ছোট পাট তুলে দিতে হয়। এতে পাট কাটার আগ পর্যন্ত মোট খরচ হয় ছয় হাজার ৫০০ টাকা।
বিনা নিড়ানিপদ্ধতি: এই পদ্ধতির উদ্ভাবক আবদুল খালেক জানান, বিনা নিড়ানিপদ্ধতিতে পাট আবাদে জমিতে প্রয়োজনমতো চাষ দিয়ে সাড়ে সাত কেজি ইউরিয়া, পাঁচ কেজি টিএসপি, ১০ কেজি এমওপি বা পটাশ, পাঁচ কেজি জিপসাম ও এক কেজি দস্তা সার দিয়ে বীজ বপন করতে হয়। এতে চাষ ও সার বাবদ খরচ হয় ৮৪৫ টাকা। চারা গজানোর পর আবার সাড়ে সাত কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হয়। পাটের বয়স ২৮ থেকে ৩০ দিন হলে দ্বিতীয় দফায় আবার সাড়ে সাত কেজি ইউরিয়া দিতে হয়। এতে গড়ে আগাছা এক ইঞ্চি হলে পাটের বৃদ্ধি ঘটে তিন ইঞ্চি। ফলে আগাছাগুলো পাটের নিচে পড়ে যায়। একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অভাবে আগাছা মরে যায়। এরপর পাটের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ দিন হলে শুধু দুই থেকে তিনজন শ্রমিক দিয়ে জমির ছোট পাটগুলো বেছে দিতে হয়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে মোট খরচ হয় এক হাজার ৭৪৫ টাকা।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপপরিচালক এ বি এম মোস্তাফিজার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনা নিড়ানিপদ্ধতি পাটচাষিদের মধ্যে নতুন উদ্যম সৃষ্টি করেছে। পদ্ধতিটি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আমরা বিষয়টি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে জানিয়েছি। তারা উদ্ভাবনটিকে সাধুবাদ জানিয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা করবে বলে জানিয়েছে।’
যেভাবে শুরু: ২০০৮ সালে চাটমোহর কৃষি বিভাগের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল খালেক গবেষণা শুরু করেন। আবাদে সনাতন-পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে নিড়ানিশ্রমিক বাদ দিয়ে শুধু সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহারে তিনি সফলতা পান। প্রথম বছর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়া গ্রামের কৃষক আজমত আলীর এক বিঘা জমিতে পাট আবাদ করে তাঁর প্রায় তিন হাজার টাকা উৎপাদন খরচ কমে। পরে এই পদ্ধতিকে তিনি ‘বিনা নিড়ানি’পদ্ধতি নাম দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে তিনি পদ্ধতিটি স্থানীয় পাটচাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এ দুই বছরে একই ইউনিয়নের ৩০ জন পাটচাষি তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে পাট আবাদ করেন এবং সফলতা পান। এর পর থেকেই উপজেলায় পদ্ধতিটি ছড়াতে থাকে।
উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা গ্রামের হয়দার আলী ও সাইদুল ইসলাম জানান, তাঁরা দুজন এবার তিন বিঘা জমিতে ‘বিনা নিড়ানি’পদ্ধতিতে পাট আবাদ করেছিলেন। দু্জনই ভালো সফলতা পেয়েছেন। আগের পদ্ধতিতে যে পরিমাণ উৎপাদন হতো, এবারও সে পরিমাণই উৎপাদন হয়েছে। তবে খরচ কমেছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।