এ কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, তা যে বাস্তবে নিশ্চিত হয়েছে তা প্রতীয়মানও হতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের মন্তব্য বিস্ময় ও চাঞ্চল্য সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। তিনি যেভাবে ‘বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার’ করার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন, তা বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেওয়া যায় না। এই চ্যালেঞ্জ কেবল পাল্টাপাল্টি বিবৃতিদানের মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। এর একটি বিচার বিভাগীয় আশু যৌক্তিক পরিণতি দরকার। বার ও বেঞ্চকে বলা হয় এক ইগলের দুই ডানা।
গত ২২ জুলাই প্রধান বিচারপতিকে লেখা বিচারপতি শামিম হাসনাইনের একটি চিঠি জনসমক্ষে এসেছে। গতকালের রায়ের পরে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিচারপতি হাসনাইন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সহপাঠী। প্রধান বিচারপতির কাছে লেখা চিঠিতে তিনি সালাউদ্দিন কাদেরের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি সম্ভবত একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
বিচারপতি শামীম হাসনাইনের সাফাই সাক্ষ্য প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে একটি আদালত অবমাননা রুল জারি হয়েছে। এখন আবার সামনে এল সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী একজন বিচারপতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যুক্তি মানলে সেই সময় শেষ হয়নি। প্রয়োজনে আপিল বিভাগেও বক্তব্য রাখতে পারেন বিচারপতি হাসনাইন। তাঁর বক্তব্য অবশ্যই বিস্তারিত জানা দরকার। ধরে নিতে হবে, ২২ জুলাইয়ের চিঠিতেই তিনি তাঁর সবটুকু বক্তব্য পেশ করেননি। আপিল বিভাগ চাইলে পুনর্বিচারের জন্য পুরো মামলার নথি ফেরত পাঠাতে পারেন ট্রাইব্যুনালে। আলোচ্য চিঠি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য থাকা উচিত।
প্রধান বিচারপতি ও বিচারকের মধ্যকার যোগাযোগ একটি প্রিভেলেজড বা বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত যোগাযোগ। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠি আর তাঁদের উভয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ওই চিঠি কেমন করে যেন সাকা চৌধুরীর আইনজীবীদের কাছে পৌঁছে গেছে। এবং তাঁরা নাকি সুপ্রিম কোর্টের প্যাডে লেখা সেই চিঠির অনুলিপি ট্রাইব্যুনালের নজরেও এনেছেন। তবে আদালত এর আগে বলেছেন যে এ রকমের চিঠির কথা তাঁদের জানা নেই। তাঁদের লিখলে তখন তাঁরা বিহিত ব্যবস্থা নেবেন।
প্রসঙ্গত. বিচাপতি শামীম হাসনাইন এবং রায়দানকারী ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ২০০৩ সালে চার মাসের ব্যবধানে হাইকোর্টে নিয়োগ পান এবং ২০০৫ সালে স্থায়ী হন।
ওই চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘এটা সত্য যে একাত্তরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলেন।’
ওই চিঠি থেকে প্রতীয়মান হয়, বিচারপতি হয়ে তাঁর সাক্ষ্য দিতে আইনগত ‘বাধা’ আছে কি না, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান। তিনি তাঁর অন্য সহকর্মীদের সঙ্গেও মূলত এই বাধা নিয়েই আলোচনা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন।
কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী বা শহীদ পরিবার সম্ভবত আইনের চেয়েও এখানে বড় বাধা হিসেবে ‘নৈতিকতার’ দিকটি তুলবেন।
ওই চিঠিতে বিচারপতি হাসনাইন বলেছেন, ‘একদিকে আমার সরকারি বাধ্যবাধকতা/আচরণ এবং অন্যদিকে আমার বিবেকের তাড়নায় আমি দগ্ধ।..’ এটা দৃশ্যত অনুশোচনীয় যে একজন বিচারকের ‘বিবেকের তাড়নার’ কথা এখনো অপ্রকাশিত।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে চ্যানেল ২৪-এর একটি অনুষ্ঠানের আলোচকদের ওপর আদালত অবমাননার রুল জারি করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় গতকালের রায়ের পর এই চিঠির বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওই চিঠি পড়ে মনে হতে পারে, বিচারকের সহপাঠী এমন তারিখে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য দণ্ডিত হচ্ছেন, যখন তিনি লাহোরে ছিলেন। আর তিনিই এই ঘটনার সাক্ষী। এই উপাখ্যান কিন্তু কাউকে রুপালি পর্দার কোনো কাহিনি মনে করিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে, ওই সময়ে পাকিস্তানে থাকার তথ্য সঠিক হলেও সাকার দায়মুক্তি ঘটছে না। গতকালের রায় কেবল একজন সাকা চৌধুরীকেই দোষী সাব্যস্ত করেনি, একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির জবানবন্দি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি করেছে। কারণ রায়ের ওই চিঠির সত্যাসত্য দৃশ্যত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
সাকা চৌধুরীর দাবি, তিনি একাত্তরের ২৯ মার্চেই দেশ ছাড়েন। আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, ২৫ মার্চের পরের পরিস্থিতির কারণে তাঁর দেশত্যাগের দাবি ‘যুক্তিসংগত সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়’। উপরন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এই দুই অপরাধের কারণে ৫ বছর করে তাঁর ১০ বছরের সাজাও ধার্য হয়েছে। আর এই দুটি অপরাধ সংঘটনের তারিখ ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই ও জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ। যদিও ৫ মে থেকে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সাকার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল।
এখন প্রধান বিচারপতির দপ্তর দ্রুততার সঙ্গে ওই বিচারপতিকে তাঁর বক্তব্য দিতে আহ্বান জানাতে পারেন। রেওয়াজ না থাকলে ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার খাতিরে নতুন রেওয়াজ গড়ে নিতে হবে। কেবল সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী নয়, সাকা চৌধুরী বিতর্কিত রাজনীতিকদের একজন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি ২০০৮ সালে তাঁকে ‘গডফাদার’ উল্লেখ করেই বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। দেশের মানুষ নিশ্চয় এমন একজন মানুষের পক্ষে বিচারপতির বিবেক দংশিত জবানবন্দি শুনতে উদগ্রীব থাকবেন।