পদ্মা–মেঘনার সর্বনাশ
‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান তিনি
আট বছর ধরে নদী থেকে ইচ্ছেমতো বালু তুলছেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান। জবাবদিহি করতে হয় না তাঁকে।
নানাভাবে আশ্বস্ত করার পরও স্পিডবোটের চালক বেশি দূর এগোতে রাজি হলেন না। সতর্ক করে বললেন, সামনে এগোলেই বিপদ হতে পারে। তাঁর সতর্কবাণী মাথায় নিয়েই দৃষ্টিসীমা আড়াল হওয়ার আগে গুনে দেখা গেল ৬৭টি ড্রেজার। কিছু ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, আর কিছু বসিয়ে রাখা হয়েছে। বালুবোঝাইয়ের পর বাল্কহেডগুলো নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা করছে।
স্পিডবোটের চালক বললেন, জায়গাটি নিরাপদ নয়। এখানে অচেনা কেউ এসে ছবি তুলতে গেলে বালু ব্যবসায়ীদের লাঠিয়ালেরা স্পিডবোট নিয়ে তাড়া করে। মুঠোফোন, ক্যামেরা কেড়ে রাখে। মারধরও করতে পারে।
জায়গাটি চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন থেকে মেঘনা নদী পেরিয়ে পদ্মার পেটে, রাজরাজেশ্বর এলাকার ডুবোচরে। প্রায় আট বছর ধরে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বালু তুলছেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। দুই শতাধিক ড্রেজার দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে এ কাজ করে চলেছেন তাঁর লোকেরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এভাবে বালু তোলার কারণে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থান দেবে গেছে। ভেঙে পড়ছে নদীর তীরও। ব্যাপকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন।
চাঁদপুর জেলার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জনস্বার্থে নৌপথ সচল করার কথা বলে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বালু তুলছেন সেলিম খান। বর্তমানে ছোট ও বড় প্রতিটি ড্রেজার দিয়ে দিনে ২০ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট বালু ও মাটি তোলা হচ্ছে। প্রতিটি ড্রেজারে ২০ হাজার ঘনফুট তোলা হলে ২০০ ড্রেজারে দিনে বালু উঠছে ৪০ লাখ ঘনফুট। মাসে তোলা হচ্ছে ১২ কোটি আর বছরে ১৪৪ কোটি ঘনফুট বালু।
ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে তোলা বালু বর্তমানে প্রতি ঘনফুট বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন টাকা। আড়াই টাকা হিসাবে দুই নদী থেকে দিনে এক কোটি টাকার বালু বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে মাসে বালু বিক্রি হচ্ছে ৩০ কোটি টাকার। বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬০ কোটিতে। ২০১৫ সাল থেকে এই টাকার একটি কানাকড়িও সরকারের ঘরে যাচ্ছে না। গত আট বছরে কমবেশি ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা সেলিম খানের পকেটে ঢুকেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বালু তোলা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সেলিম খান উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা দেখিয়ে নদী থেকে আগ্রাসী কায়দায় বালু তুলছেন।
জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ প্রথম আলোকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বালু তোলা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তিনি চিঠি দেবেন।
সেলিম খান যে পদ্ধতিতে বালু তুলছেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে তা নিষিদ্ধ। এই আইন বলছে, নদীতীর ভেঙে যেতে পারে এবং মৎস্য ও জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেখান থেকে বালু ও মাটি তোলা নিষিদ্ধ।
কে এই সেলিম খান
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান। বর্তমানে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ৯ জন সদস্যসহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি।
ওই ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সেলিমের পারিবারিক অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে জেলা বিএনপির প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তিনি। এর আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন সেলিম খান। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে বালু তোলার একচ্ছত্র সম্রাট বনে যান সেলিম। উল্লেখ্য, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুর–৩ (সদর–হাইমচর) আসনের সাংসদ।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণে সেলিম খানের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। অভিযোগ উঠেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাব করা জায়গার বড় অংশটি নামে-বেনামে কিনে নেন তিনি। এসব জমির দলিল করতে গিয়ে মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি মূল্য দেখানো হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে কৌশলে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এর কারণ। যাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছে, তাঁরা নামমাত্র টাকা পেয়েছেন বলে অভিযোগ।
বালুর ব্যবসায় নামার পর সেলিম খানের বিপুল সহায়-সম্পত্তি নিয়ে এলাকায় নানা কথা প্রচার আছে। বালুমহালের টাকা দিয়ে সিনেমায় লগ্নি করেছেন তিনি। এরই মধ্যে তাঁর প্রযোজিত একাধিক সিনেমা মুক্তিও পেয়েছে।
২০১৯ সালে দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে সেলিমের নাম আলোচনায় আসে। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সেলিম কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
মন্ত্রীর ১৫ চিঠি
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেলিম খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বালু তোলার কাজ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত—সাত বছরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অন্তত ১৫টি ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়েছেন। এসব চিঠিতে সেলিমের ছেলে ও ভাইয়ের নামের প্রতিষ্ঠানকেও বালু তোলার কাজ দিতে সুপারিশ করেছেন মন্ত্রী।
সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সেলিম খানের ছেলের নামের প্রতিষ্ঠান শান্ত এন্টারপ্রাইজকে ৮ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট বালু ও মাটি তোলার অনুমতি দিতে অনুরোধ করেছেন দীপু মনি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে শিক্ষামন্ত্রী দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে দেশীয় প্রযুক্তির ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার অনুমতি দিতে অনুরোধ করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, ২০০৯ সালের আগে দরপত্রের মাধ্যমে বালু তোলার কাজ বণ্টন করা হতো। সরকারও রাজস্ব পেত। কিন্তু ধীরে ধীরে তা সেলিম খানদের দখলে চলে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সেলিমের মধ্যে কী এমন মধু আছে যে তাঁকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সব দিয়ে দেওয়া লাগবে, বুঝি না।’
নদী থেকে বালু তোলার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ডিও লেটার দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর মন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের কাছে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। ওই দিনই ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হয়, মন্ত্রী ঢাকার বাইরে আছেন। ১ মার্চের মধ্যে লিখিতভাবে জবাব দেবেন। এ সময়ের মধ্যে জবাব না পেয়ে তথ্য কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে উল্টো জানতে চান, এখনো জবাব পাননি? আপনাকে তো মন্ত্রী জবাব দেবেন বলে জানিয়েছেন। পরে তিনি বলেন, মন্ত্রী ঢাকার বাইরে আছেন। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। পরে গতকাল দিবাগত ১২টা ২২ মিনিটে ই–মেইলের মাধ্যমে মন্ত্রীর বক্তব্য পাঠান তথ্য কর্মকর্তা। এতে দীপু মনি বলেন, ‘চাঁদপুর–৩ আসনের সাংসদ হিসেবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ ও ফেরি চলাচলের সুবিধার্থে ড্রেজিং করা জরুরি মনে করে জনস্বার্থে ডিও লেটার প্রদান করেছি। বিআইডব্লিউটিএর হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ চার্টের নির্ধারিত স্থান থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু/মাটি উত্তোলন করা হয়, সরকারকে সকল প্রকার রাজস্ব প্রদান করে।’
সরেজমিন: কঠোর নিরাপত্তায় চলে ড্রেজিং
পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু তোলার চিত্র দেখতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান এই প্রতিবেদক। দুপুরে চাঁদপুর বড় স্টেশন থেকে স্পিডবোটে যাত্রার ১৫ মিনিট পর দেখা মেলে সেলিম খানের নিয়ন্ত্রণাধীন সারি সারি ড্রেজার। এ সময় মুঠোফোনে ছবি তুলতে গেলে স্পিডবোটের চালক নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ড্রেজিংকাজের আশপাশে ঘুরতে মানা। এর চারপাশে কঠোর নিরাপত্তাবলয় আছে। ছবি তুলতে দেখলেই তারা ধাওয়া করবে।
আসা-যাওয়ার পথে দূর থেকে পাঁচটি কাছাকাছি জায়গায় অসংখ্য ড্রেজার চোখে পড়ে।
স্পিডবোটের চালকের সতর্কবার্তা মাথা থেকে ঝেড়ে আবারও ড্রেজারের ছবি তোলার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। মুঠোফোন হাতে নিতেই ঝাপটা দিয়ে হাত ধরে চালক এবার অনুরোধ করেন ছবি না তুলতে। পরে ওই চালক বললেন, দুই বছর সেখানে কাজ করেছেন তিনি। দেড় বছর আগে তিনি যখন সেখানে কাজ করতেন, তখন দিনরাত সব ড্রেজার চলত। এখন বড় ড্রেজারগুলো চলে রাতে। ওই সব ড্রেজারে এক রাতেই বালু তোলা যায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ঘনফুট।
কারও কাছে তথ্য নেই
নদীপথ সচলের নামে ডুবোচর থেকে সেলিম খান এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ বালু তুলেছেন, সে তথ্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের কোনো দপ্তরে নেই।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ হিসাব চাইলে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে আরও কী পরিমাণ মাটি ও বালু তুলতে হবে, সেই হিসাব তাঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, সেই তথ্য পাননি।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন ছয় ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে ২০১৪ সালে একটি মহলের প্রভাবে সেলিম খানের ভাই বোরহান উদ্দিনকে ৫০ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। পরের বছর সেলিম খানও বালু তোলা শুরু করেন। কিন্তু কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, সে তথ্য কেউ জানে না।
জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, সেলিম চেয়ারম্যানের বাইরে পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে কেউ বালু তুলতে পারছেন না। কেউ চেষ্টা করলেও তাঁদের ড্রেজার তিনি জব্দ করানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তির দুটি ড্রেজার আটক করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে নামে-বেনামে যত ড্রেজার আছে, সব কটির নিয়ন্ত্রণ সেলিম চেয়ারম্যানের হাতে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরাও চাই অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধ হোক। নিয়মের মধ্য থেকে দরপত্র আহ্বান করে অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া হোক।’
কানাকড়িও পাচ্ছে না সরকার
সেলিম খান খেয়ালখুশিমতো বালু তুললেও ২০১৫ সাল থেকে সরকার এক টাকাও রাজস্ব পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। ২০ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে।
জেলা প্রশাসক বলেন, ২০১৪ সালে সেলিমের ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের চুক্তি ছিল, প্রতিদিন কত বালু তোলা হচ্ছে, তা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তত্ত্বাবধান করবেন। কিন্তু ২০১৫ সালে আদালতের কাগজ দেখিয়ে সেলিম খান তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের নামে বালু তুলছেন। কিন্তু কারা বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে কোনো চুক্তিপত্র বা নথি নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নদী থেকে বালু তোলার বিনিময়ে রাজস্ব হিসেবে ২০০৮ সালে জেলা প্রশাসনকে প্রতি ঘনফুটের জন্য ২৫ পয়সা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৩ শতাংশ আয়কর বাবদ মোট ১৮ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন সেলিম খান। এর বাইরে একই কাজের জন্য বিআইডব্লিউটিএকে প্রতি ঘনফুট বালুর জন্য ১৫ পয়সা হারে টাকাও দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন হওয়ার পর নদী থেকে বালু তোলার কাজটি দেখভালের দায়িত্ব বর্তেছে জেলা প্রশাসকের কাছে।
২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সেলিম খান অন্তত ১ হাজার ১৫২ কোটি ঘনফুট (বছরে ১৪৪ কোটি ঘনফুট হিসাবে) বালু তুলেছেন। জেলা প্রশাসনকে প্রতি ঘনফুটে ২৫ পয়সা করে রাজস্ব দিলে সরকারি কোষাগারে জমা পড়ত ২৮৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ টাকা তো রয়েছেই।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি সেলিম খান জেলা প্রশাসনকে এক চিঠি দিয়ে বালু তোলার রাজস্ব হিসেবে ৯ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জমা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। জবাবে জেলা প্রশাসন বলেছে, আদালতের আদেশের পর জেলা প্রশাসন থেকে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও প্রায় চার বছর পর কেন সেলিম খান রাজস্ব দিতে চাইছেন, তাঁর কাছে এর উত্তর চাওয়া হয়েছে।
নির্দ্বিধায় বালু তোলার নেপথ্যে যা
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, নদীতে ডুবোচর সৃষ্টির কারণে নৌপথে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে—এই কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে সেলিম খান নিজ খরচে জনস্বার্থে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছে আবেদন করেন।
নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয় হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়।
সেলিম খানের ওই আবেদন মঞ্জুর হলে তিনি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ শেষে নদী থেকে এককভাবে বালু তুলতে যান। তখনই প্রশাসন থেকে কেবল এক ব্যক্তিকে নদী থেকে বালু তোলার বিষয়ে আপত্তি তুললে সেলিম খান যান উচ্চ আদালতে। সেখানে তিনি নিজ খরচে জরিপকাজ শেষ করার যুক্তি দেখিয়ে বালু তোলার অনুমতি চান। পরে আদালতের একটি আদেশে তাঁকে ৩০ কোটি ৮৪ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে এই আদেশ দেখিয়েই বালু তুলছেন তিনি।
চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম খানকে যেহেতু এ নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তাই তিনি ইচ্ছেমতো নদী থেকে বালু তুলছেন।
এসব বিষয়ে জানতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সেলিম খানের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনে ‘সরি সরি’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিছুক্ষণ পর কল করলে আর ধরেননি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বালু তোলার জন্য সেলিম খান ২০১৫ সালে রিট মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালে তিনি বালু তোলার অনুমতি পেয়েছেন। তবে ২০১৫ সাল থেকেই তিনি বালু তুলে আসছেন। মামলার কারণে ওই তিন বছর জেলা প্রশাসন কোনো দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি।
বিপর্যস্ত পরিবেশ, হুমকিতে শহর
২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া এক চিঠিতে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। চিঠিতে বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাছবিচারহীনভাবে নদী থেকে বালু তোলার কাজ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে চাঁদপুর শহর ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। গত ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপর জেলার উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেবল চাঁদপুরেই নয়, যেকোনো নদ-নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে পাশের শহর হুমকির মধ্যে পড়বে।
নদ-নদী থেকে বালু তোলার কাজে বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যে ড্রেজার ব্যবহার করে, সেটি বোমা ড্রেজার নামে পরিচিত। এর দাপ্তরিক নাম সাকশন ড্রেজার। এই ড্রেজারের মাধ্যমে নিয়ম মেনে কখনোই মাটি ও বালু তোলা হয় না বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ের ড্রেজিং শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বোমা ড্রেজার দিয়ে পানির তলদেশ থেকে একটি জায়গা থেকে ৭০-৮০ ফুট গভীর পর্যন্ত বালু তোলা হয়। এতে আশপাশের জায়গা ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে এটি তীরে গিয়ে ভাঙনের সৃষ্টি করে।
এভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকির মধ্যে ফেলে বালু উত্তোলন কি চলতে থাকবে, জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের রায় পর্যালোচনা করে দেখেছি, সেলিম খানকে ডুবোচর থেকে বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বালু বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাঁর বালু তোলার প্রক্রিয়াটিও আইনানুগ হচ্ছে না। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হবে।’