বস্তিবাসীদের আয়ের অর্ধেক চলে যায় ঘরভাড়ায়

বস্তিতে প্রতি বর্গকিমিতে বাস করে আড়াই লাখ মানুষ। শ্রমজীবী মানুষেরাই বস্তির বাসিন্দা।

আয়তনের দিক থেকে ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন এই বস্তি প্রায় ৪০টি ফুটবল মাঠের সমান। এই বস্তিতে ১০ হাজারের বেশি ঘর রয়েছে। এখানকার প্রতিটি ঘরের (এক কক্ষ) ভাড়া ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।

গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দিনমজুরসহ শ্রমজীবী মানুষেরাই এই বস্তির বাসিন্দা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের উদোগে করা এক সমীক্ষার তথ্য বলছে, বস্তির এই মানুষদের আয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় শুধু ঘর ভাড়ায়।

কড়াইল বস্তিতে থাকেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলী হোসেন। দুই কক্ষের একটি ঘরে পাঁচজনের পরিবার নিয়ে থাকতে তাঁর খরচ হয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা। মানুষের বাসাবাড়ির পয়োনালা পরিষ্কার করেন আলী হোসেন। প্রতিদিন তাঁর কাজ জোটে না। ফলে খাবারসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে ঘরভাড়া দেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আলী হোসেনের মতো বস্তিতে থাকা নিম্ন আয়ের এই মানুষেরা ঘরভাড়ার পেছনে কত টাকা ব্যয় করেন, সেটি উঠে এসেছে বুয়েটের সমীক্ষায়। গতকাল শনিবার দুপুরে বুয়েটের কাউন্সিল হলে ‘নগরে নিম্নবিত্তের আবাসন’ নিয়ে এক সেমিনারে এই সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।

সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বস্তি রয়েছে ৩ হাজার ৪০০টি। এসব বস্তিতে কমপক্ষে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ বাস করে।

বস্তিগুলোর বেশির ভাগই খাল, লেক ও নদীর আশপাশে। বস্তিতে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বাস করে, যা ঢাকার অন্যান্য অংশের (বস্তি ছাড়া) গড় জনঘনত্বের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। বস্তির প্রতিটি ঘরে পাঁচ থেকে আটজন করে বাস করে। এসব ঘরের জন্য কড়াইল বস্তিতে বসবাসকারীদের আয়ের প্রায় ৬৬ শতাংশ এবং মিরপুরের ভাষানটেক বস্তিতে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়।

ঘরভাড়ায় বাড়তি ব্যয়ের পাশাপাশি বস্তির মানুষকে থাকতে হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। বস্তির সব ঘরে সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকে না। বস্তির ভেতরে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এ জন্য বস্তির একজন মানুষকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়।

অন্যদিকে বস্তিতে তিন থেকে চারটি পরিবারের জন্য একটি শৌচাগার থাকে। ফলে প্রয়োজনের সময় বস্তির মানুষকে শৌচাগার ব্যবহারের জন্য গড়ে সাত মিনিট অপেক্ষায় থাকতে হয়। আর বস্তির ভেতরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এতটাই নাজুক যে ভেতরে ঢুকলে মনে হয় ঘিঞ্জি জায়গাটি যেন বর্জ্যের স্তূপ।

আরও পড়ুন

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া মানুষদের একমাত্র আশ্রয় ঢাকা শহর। প্রতিদিন ঢাকায় আসছে দুই হাজার মানুষ। নতুন এই অভিবাসীদের বাসস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া উচিত বলে তিনি দাবি করেন।

বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট করে দিলে গ্রাম থেকে নতুন করে আসা মানুষ আবার বস্তিতে উঠবে বলে মনে করেন রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা। তিনি বলেন, গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে, যাতে গ্রাম থেকে শহরে মানুষ আসা বন্ধ হয়। শুধু সরকারের একার পক্ষে বস্তিবাসীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা কঠিন হবে।

বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট

বস্তিবাসীদের জন্য রাজধানীর মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট এলাকায় ১৪ তলা মোট পাঁচটি ভবন নির্মাণ করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে তিনটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এই তিনটি ভবনে ফ্ল্যাট রয়েছে ৩০০টি। এসব ফ্ল্যাট বিভিন্ন বস্তিতে থাকা ৩০০ জনকে ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৫১০ বর্গফুট (কমন স্পেসসহ ৬৭৩ বর্গফুট)। প্রতি ফ্ল্যাটে শোবার ঘর দুটি। এ ছাড়া বসার ও খাবার ঘর, বারান্দা, শৌচাগার ও স্নানাগার রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য সরকার ভাড়া নেবে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা।

তবে এই ভাড়ার সঙ্গে যোগ হবে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবার খরচও (ইউটিলিটি বিল)। তাতে আরও প্রায় তিন হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে বস্তির একজন বাসিন্দাকে ফ্ল্যাটে থাকার জন্য মাসে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা খরচ করতে হবে। বস্তিবাসীর জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট প্রকল্পের উদ্বোধন ও হস্তান্তর করা হয় গত বছরের ৩ আগস্ট।

ওই দিনই ৩০০ বস্তিবাসীর হাতে ফ্ল্যাটের সাময়িক ‘ভাড়াপত্র’ তুলে দেওয়া হয়। তবে তাঁরা এখনো ফ্ল্যাটে ওঠার অনুমতি পাননি। এর মধ্যেই যাঁরা ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁরা ভাড়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। ভাড়া না কমানো হলে ফ্ল্যাটে উঠবেন না বলে অনেকে জানিয়েছেন।

এদিকে গতকাল বুয়েটের সেমিনারে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বস্তিবাসীর জন্য বহুতল আবাসিক ভবন কার্যকর হবে না। বস্তির মানুষ হেঁটে উঠতে পারবেন, এমন ভবন নির্মাণ করা দরকার। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ভবন নির্মাণের পর বিক্রির চেয়ে ভাড়াভিত্তিক হস্তান্তর বেশি কার্যকর বলে তিনি জানান।

অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন

সেমিনারে রাজউকের নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) সাশ্রয়ী আবাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে ৫৫টি জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে।

এর মধ্যে শ্যামপুরে একটি ও মোহাম্মদপুরের একটি জায়গায় আপাতত পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করলে প্রণোদনা হিসেবে তাঁদের প্রচলিত এফএআর (ভবনের উচ্চতাসংক্রান্ত সীমা) এর চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হবে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য দেন বুয়েটের ইউআরপি বিভাগের প্রধান আফসানা হক। ইউআরপি বিভাগের অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বুয়েটের সহ–উপাচার্য আবদুল জব্বার খান, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফুল আলম, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকায় মোট আবাসনের মাত্র ৭ শতাংশের জোগান দেয় সরকারি খাত। রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নির্মাণ করা ভবনগুলোও হয় উচ্চবিত্তদের জন্য।

সেমিনারে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, বস্তিবাসীদের জন্য ভবন নির্মাণের জন্য প্রতি বর্গফুটে তিন হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।

এই হিসাবে ঢাকার বস্তিবাসীদের জন্য ভবন নির্মাণে ২২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার মতো খরচ পড়বে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প জমা দেওয়ার জন্য খরচ বাড়ানো হয়। এখন পর্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যেসব প্রকল্প পাস হয়েছে, সেখানে প্রতি বর্গফুটে খরচ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

প্রকৃত অর্থেই এ ধরনের ভবন নির্মাণ করতে কত টাকা খরচ হতে পারে, সে–সংক্রান্ত এটি গাইডলাইন বুয়েট কর্তৃপক্ষকে তৈরি করে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ জানান, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের শুধু একটি ভবন তৈরিতে প্রতি বর্গফুটে খরচ ধরা হয়েছে ৮৯ হাজার টাকা। আরেক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ভবন তৈরিতে প্রতি বর্গফুটে খরচ ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। এসব কাজে দাতা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।